করনা ভাইরাসঃ ইসলাম ও বিজ্ঞান

তাইফুর সরোয়ারঃ-

ইসলাম পূর্ণঙ্গ জীবন বিধান। মানব জীবনের সব সমস্যার সমাধান আছে বলেই এই জীবনব্যবস্থা সকল যুগের সকল মানুষের উপযোগী।

বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাস এক মহা আতঙ্কের নাম। চীন থেকে শুরু হয়ে এই ভাইরাস মহামারি আকারে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, অামেরিকা সহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মন্ত্রী, রাষ্ট্র প্রধান, উপদেষ্টা কেউই বাদ যাচ্ছেন না এই ভাইরাসের হাত থেকে। ভয়াবহ সংক্রমক এই ভাইরাসে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ দেশের ৪২৮৪০৫ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯১২০ জনের। আমাদের বাংলাদেশেও ৩৯ জনের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে যার মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

করনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোন ঔষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত না হওয়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করনা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হিসেবে জনসচেতনতার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করনা প্রতিরোধে বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশি নিয়ন্ত্রণ, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন (সামাজিকভাবে মানুষ থেকে দূরে থাকা), এবং লক ডাউন (বিশেষ এলাকায় চলাচল সীমিত করার মাধ্যমে অন্য এলাকা থেকে আলাদা) করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। সংস্থাটির মতে শুধু এগুলো মেনে চলার মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ কমানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়।

ইসলাম ধর্মেও করনাসহ যেকোন ভাইরাস মোকাবেলায় অনুরূপ বিধানের কথা বলা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বিশেষজ্ঞরা বারবার হাত ধৌত করার পরামর্শ দিয়েছেন। ইসলামের বিধানেও কিন্তু সব সময় এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কেনানা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান কম করে হলেও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পূর্বে পবিত্রতা অর্জনের জন্য ওজু করেন। তিনি দৈনিক ৫ বার ওজু করার জন্য ১৫ বার হাত, পা, নাক, মুখ ও চোখ পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করেন। সময়মতো দিনে একবার গোসল করেন। পোশাক-পরিচ্ছদ সবসময় ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখেন। ঈমানদার লোকের বসত-বাড়ি ও ঘরের আঙিনা পরিচ্ছন্ন থাকে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন, তিনি পরিচ্ছন্ন এবং তিনি পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করেন।’ (তিরমিজি)

করনা যাতে সমাজে মহামারি আকারে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পরতে না পারে তার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেন। কিছু এলাকাকে লক ডাউন করা হয়। হাদিসেও মহামারি থেকে রক্ষা পেতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা করে রাখা এবং চলাচল সীমিত করার বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মহামারি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা থেকে চলে এসো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় জেয়ো না। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ১০৬৫)

তরুণ মার্কিন গবেষক ড. ক্রেইগ কন্সিডাইন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অবস্থিত রাইস ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক হিসেবে কর্মরত। এক প্রতিবেদনে তিনি জানান, ইমিউনোলজিস্ট ডা. অ্যান্থনি ফসি এবং মেডিক্যাল রিপোর্টার ডা. সঞ্জয় গুপ্তের মতো বিজ্ঞ চিকিৎসকরা করোনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সুন্দর ব্যবস্থাপনায় হোম কোয়ারেন্টিনের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে সুস্থ লোকদের জন্য জনসমাগম এড়িয়ে একাকী জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, এসব উপায়ই করোনা থেকে বেঁচে থাকার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।

পৃথিবীবাসীর কাছে প্রশ্নরেখে তিনি বলেন- আপনারা কি জানেন মহামারির সময়ে সর্বপ্রথম কে এই কোয়ারেন্টাইনের উদ্ভাবন করেছেন? আজ থেকে প্রায় ১৩শ বছর আগে ইসলাম ধর্মের নবী মোহাম্মাদ (সা.)’ই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম ‘কোয়ারেন্টিন’-এর ধারণা দেন। তাঁর সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ছিল না। তবে তিনি এসব রোগব্যাধিতে করণীয় সম্পর্কে তার অনুসারীদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন এক কথায় তা ছিল দুর্দান্ত! তাঁর মূল্যবান সেই পরামর্শ মানলেই করোনার মতো যেকোন মহামারী থেকে যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করা যায়।

ড. ক্রেইগ কন্সিডাইন আরো জানান এ প্রসঙ্গে মহানবী বলেছেন, “যখন তুমি কোনো ভূখণ্ডে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার খবর শুনতে পাও তখন সেখানে প্রবেশ কোরো না। পক্ষান্তরে প্লেগ যদি তোমার অবস্থানস্থল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে ওই জায়গা ত্যাগ কোরো না।” এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানা পরিস্থিতিতে ইসলামের নবী মোহাম্মাদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের বিশেষ করে রোগব্যাধিতে আক্রান্ত লোকদের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করতেন। ড. কন্সিডাইন এ ব্যাপারে মহানবী (স.) এর আরো কিছু অমূল্য বাণীর কথা উল্লেখ করেন যেগুলো হলো, “পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ”, ‘ঘুম থেকে জেগেই দুই হাত ধৌত করো। কেননা ঘুমের মধ্যে তোমার হাত কোথায় স্পর্শ করেছে তুমি জান না”, “খাওয়ার আগে ও পরে ধৌতকরণের মধ্যেও বরকত রয়েছে” ইত্যাদি। মোটকথা, তাঁর (মহানবী স.) অনুসারীরা যেকোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হোক তা থেকে পরিত্রাণের ব্যাপারেই তিনি (মহানবী স.) তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি (মহানবী স.) যেমন ব্যাপক অবদান রেখে অমর হয়ে আছেন, ঠিক তেমনই মানুষের জীবনযাপন বিষয়ক মহামূল্যবান যে পরামর্শ তিনি দিয়ে গেছেন তা আজও অনুকরণীয়।

ব্যাপক হারে মানুষ আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হলে আল্লাহ পাক পৃথিবীতে গজব নাজিল করেন; যাতে মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পেরে তাওবার মাধ্যমে আবার ফিরে আসতে পারে। এই গজব বা মহামারির সময় মুসলমান হিসেবে আমাদের কি করা উচিত? এ বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা অনেক স্পষ্ট। এসকল অবস্থায় আমাদের সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে, আল্লাহর তাকদীরের উপর খুশী থাকা। সাওয়াবের আশা নিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম সর্বপ্রথম আমাদেরকে এসব অবস্থায় সান্ত্বনা দিয়েছেন। হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন, “মহামারি আল্লাহ তাআলার একটি শাস্তি। তবে তা মুসলমানদের জন্য আল্লাহর রহমত”। (বোখারী ৩৪৭৪)  যারা আল্লাহ তাআলার উপর বিশ্বাস রাখে তাদের পায়ে যদি কোনো কাটাও ফুটে, আল্লাহর কাছে এরও বিনিময়  পাওয়া যাবে। সুতরাং এ অবস্থায় যারা ধৈর্য্য ধারণ করে তাদের জন্য এটি মহামারি নয়। এদের জন্য আল্লাহর রহমত। এর মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ হয়। এসকল মহামারির সময় যারা সাওয়াবের নিয়তে ধৈর্য ধারণ করে, এবং আক্রান্ত  এলাকা থেকে পালিয়ে যায় না হাদীস শরীফে এসেছে তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “মহামারিতে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত”। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৩০)

যে সকল মুসলমান এসকল আক্রান্ত এলাকায় রয়েছেন তাদের উচিত সেখানে অবস্থান করা। সেখান থেকে না আসা। তা ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ধৈর্যধারণ করা, সওয়াবের আশা করা। তাকদীর যা আছে তাই হবে। যদি আমরা ধৈর্য ধরি তাহলেও তাই ঘটবে। আমরা সওয়াব পেয়ে যাব। আর যদি হায় হুতাশ করি, তাহলেও তাকদীরে যা আছে তাই হবে কিন্তু আমরা সওয়াব থেকে মাহরুম হব। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দোয়া হলো মুমিনের হাতিয়ার।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘দোয়া হলো মুমিনের অস্ত্র।’ দোয়া সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দোয়ার শক্তি এত বেশি যে, তা বান্দার তাকদির পর্যন্ত বদলে দিতে পারে।’ দোয়া সম্পর্কে একটি বিষয় অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জেনে রাখা দরকার যে, মানুষের সাধ্যের মধ্যে সবটুকুন চেষ্টা করার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার সাহায্য চাইতে হবে। চেষ্টা ছাড়া দোয়া কবুল হয় না বলে হাদিসে বলা হয়েছে। সম্প্রতি ‘করোনা’ ভাইরাস আতঙ্কে বিহ্বল পুরো বিশ্ববাসী। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে চলতে হবে এ সম্পর্কে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব দিকনির্দেশনা অনুসর করে মনে মনে বিশ্বাস রাখতে হবে, কোনো বিপদ হলে আল্লাহপাকের ইচ্ছেতেই হবে। আবার বিপদমুক্তি হলে তাও আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছেতেই হবে। এই বিশ্বাস পোষণের পাশাপাশি হাদিস শরিফে বিপদমুক্তির যে সব দোয়া বর্ণিত হয়েছে ওই সব দোয়া আমল করলে আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালার রহমতে শত বিপদেও আমরা নিরাপদ থাকব। সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এবং সন্ধ্যায় তিনবার এই দোয়া পড়বে, আল্লাহ তায়ালার দয়ায় সে সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত থাকবে।

“বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামাই, ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম”। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৮৮)

অর্থ: আল্লাহ তায়ালার নামে আমার সকাল-সন্ধ্যা শুরু হলো। যার নামের বরকতে পৃথিবী এবং পৃথিবীর বাইরের কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সব শোনেন এবং সব জানেন।
অন্য হাদিসে আছে আনাস (রা.) বলেন, ‘যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর ওপর কোনো কাজ কঠিন হয়ে দেখা দিত, তখন তিনি এ দোয়াটি পড়তেন। “ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু বিরাহমাতিকা আসতাগিছ।’
অর্থ: হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্ব চরাচরে ধারক! আমি তোমার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (তিরমিজি মিশকাত, হাদিস নম্বর: ২৪৫৪)

এছাড়া নবিজি (সা.) মহামারি থেকে বাঁচতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে বলেছেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি,ওয়া সাইয়ি ইল আসক্কাম”।

করনা ভাইরাসের মতো মহামারি মোকাবেলায় আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দিকনির্দেশনাগুলোর কথা বলছেন তা তেরশত বছর আগেই মহানবী (স.) এর দেখানো জীবন ধরাতেই পাওয়া যায়। এসব দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে আল্লাহপাকের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আমাদের কৃত কর্মের জন্য তওবা করা, বেশি বেশি দোয়া ও ইবাদত মাধ্যমে ধৈর্যধারণ করতে হবে। আমাদের দোয়া এবং ইবাদতের বরকতে মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে এই মহামারি থেকে মুক্তি দান করুক। আমীন।

তথ্য সূত্রঃঃ আই ই ডি সি আর, দৈনিক কালের কন্ঠ, বিবিসি বাংলা এবং ইন্টারনেট

SHARE