মৃতের সংখ্যা আট হাজার ছুঁই ছুঁই

মোঃ ইমরান হুসাইন মুন্নাঃ-

নভেল করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। উৎসস্থল চীনে ভাইরাসটি প্রায় নিয়ন্ত্রণে আসার পর বিপুলসংখ্যক আক্রান্ত ও প্রাণহানি ঘটছে ইতালি, ইরান, স্পেন, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা আট হাজার ছুঁই ছুঁই। বেড়েছে মৃত্যুর হারও। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মৃতের হার ৩.৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগেও এ হার ছিল ৩.৪ শতাংশ। অন্যদিকে করোনা মহামারির বর্তমান কেন্দ্রস্থল ইউরোপকে কার্যত অবরুদ্ধ করা হচ্ছে। চলমান সংকটকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ।

ইতালির পর এবার ফ্রান্সে দুই বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজি ইমতিয়াজ হোসেন গতকাল মঙ্গলবার জানান, দুজনের অবস্থাই স্থিতিশীল। তাঁদের একজন হাসপাতালে আছেন।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিশ্বের ১৬৩টি দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯৪ হাজার ৭৭৭ জনে। মৃত্যু হয়েছে সাত হাজার ৮৯৬ জনের। সুস্থ হয়েছে ৮১ হাজার ৯৩ জন।

গতকাল বাংলাদেশে নতুন করে দুজনের শরীরে করোনার অস্তিত্ব মিলেছে। তাতে করে কভিড-১৯ শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১০-এ। আর প্রতিবেশী ভারতের মুম্বাইয়ে গতকাল মারা গেছে একজন। তাতে করে দেশটিতে কভিড-১৯ রোগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল তিনে; আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১৪২ জন। করোনা মোকাবেলায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার পর তাজমহল বন্ধ ঘোষণা করেছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়েছে গতকাল। সেখানে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ২৪৭ জন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের মধ্যে আট দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও এ অঞ্চলে কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে থাইল্যান্ড (১৭৭), ইন্দোনেশিয়া (১৭২), শ্রীলঙ্কা (৪৪), মালদ্বীপ (১৩), নেপাল (১) ও ভুটানে (১) জন।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। গতকাল এক বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপল সিং এই তাগিদ দেন। ড. পুনম ক্ষেত্রপল সিং বলেন, ‘পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আরো বেশি মানুষ সংক্রমিত হওয়ার আগে আমাদের তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এ অঞ্চলে ভাইরাসটি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে জানিয়ে ড. পুনম বলেন, ‘ভাইরাস ছড়ানোর গতিবিধি অনুযায়ী আরো অনেক মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বিস্তার রোধে সতর্কতা ও নজরদারি বাড়ানো হলেও ভাইরাসটি প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিতভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

করোনা নিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে ইউরোপে। ওই মহাদেশের বিভিন্ন দেশে জরুরি অবস্থা, অবরুদ্ধ ঘোষণা, সীমান্ত বন্ধের মতো কঠোর পদক্ষেপ এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইউরোপের শেনঝেনভুক্ত দেশে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপিয়ান কমিশন। সংস্থার প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন বলেছেন, মঙ্গলবার থেকেই এই বিধি-নিষেধ আরোপ করা যায় কি না, তা নিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তাঁর ভাষায়, ‘ভ্রমণ যত কম হবে, ভাইরাসটি ততই আমরা প্রতিরোধ করতে পারব।’

এর আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ বলেন, ইউরোপের বাইরের ও ভেতরের সব দেশের মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করা হবে। টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট বা চূড়ান্ত উপায় হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বহির্ভূত এবং ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সব ধরনের ভ্রমণ স্থগিত করা হবে।’

ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডার লেয়েন এক ভিডিও কনফারেন্সে জানিয়েছেন, দীর্ঘ মেয়াদের বাসিন্দা, ইইউ নাগরিক এবং কূটনীতিকদের পরিবারের সদস্যরা আন্তঃসীমান্তে ছাড় পাবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং লোকজনের পণ্য পরিবহন ছাড় পাবে। এই পদক্ষেপ অন্তত ৩০ দিন স্থায়ী হবে।

শেনঝেন চুক্তির কারণে সীমান্ত তল্লাশি ছাড়াই লোকজন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অবাধে চলাচল করতে পারে। এ ছাড়া ইইউ সদস্য কিন্তু শেনঝেনভুক্ত নয় এমন দেশগুলো এবং সম্প্রতি ইইউ ত্যাগ করা যুক্তরাজ্যকেও এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বলা হয়েছে।

বর্তমান সংকটকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট তাঁর দেশের জনগণকে ১৫ দিন ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুর থেকে কার্যকর হওয়া এ ‘অবরুদ্ধ-আদেশে’ বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ বা সামাজিক মেলামেশা কোনোভাবেই করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ম্যাখোঁ বলেন, এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্যাফে ও অপ্রয়োজনীয় দোকান বন্ধ করা হলেও বর্তমান বাস্তবতায় তা উপযুক্ত নয়।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইতালি ও স্পেনে যে অবরুদ্ধ অবস্থা চলছে, তা সাধারণত যুদ্ধকালে দেখা যায়। গত সোমবার থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে স্পেন ও রাশিয়া। জার্মানি বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কয়েকটি সীমান্ত।

করোনা প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একসঙ্গে ১০ জনের কম লোককে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করছি, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আগামী জুলাই বা আগস্ট নাগাদ এই ভাইরাসের প্রকোপ শেষ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করলেও জরুরি অবস্থা আরো বেশি সময় ধরে স্থায়ী হতে পারে।’

ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কোয়ারেন্টাইন করার বা কানাডার সঙ্গে এখনই সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি বলে জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব এলাকায় যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হতে পারে বলে তিনি জানান। অবশ্য এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকদের জন্য সীমান্ত বন্ধ করেছে কানাডা।

করোনা মোকাবেলায় অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। আর সুইজারল্যান্ড দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। করোনা ঠেকাতে চার্চ, মসজিদ ও সিনাগগে জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে জার্মানি। পাশাপাশি খেলার মাঠ ও অপ্রয়োজনীয় দোকান বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

চীনের পর এখন সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ইতালিতে। দেশটি অবরুদ্ধ করেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৩৪৯ জনের। গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫০৩ জনে। মোট আক্রান্ত ৩১ হাজার ৫০৬ জন।

ইতালির পর নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে। গতকাল সেখানে নতুন করে মারা গেছে ১৩৫ জন, সংক্রমিত হয়েছে এক হাজার ১৭৮ জন। তাতে করে মোট মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৮৮ জন ও ১৬ হাজার ১৬৯ জন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, করোনা মোকাবেলায় রাজনীতিকসহ ৮৫ হাজার বন্দিকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে তেহরান। মুক্তদের মধ্যে ৫০ শতাংশই নিরাপত্তাজনিত অপরাধের দায়ে কারাভোগ করছিল।

মানুষের ওপর টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটলের একটি গবেষণাগারে চারজনের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস এ তথ্য জানিয়েছে।

সিএনএন বলছে, ৪৫ জন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্কের ওপর ছয় সপ্তাহ ধরে এই পরীক্ষা চালানো হবে। প্রত্যেকের শরীরে দুটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এই টিকা দেওয়া হবে, দ্বিতীয় ইঞ্জেকশনটি দেওয়া হবে ২৮ দিন পর।

বিবিসি জানিয়েছে, পরীক্ষামূলক এই প্রয়োগ সফল হলেও সাধারণ মানুষের জন্য তা বাজারে আসতে ১৮ মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সিয়াটলের দুই সন্তানের জননী ৪৩ বছরের এক নারীকে প্রথম এই টিকা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা আমার জন্য দারুণ সুযোগ।’

নভেল করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও জোর চেষ্টা চলছে।

আক্রান্তের তালিকায় ডাব্লিউএইচওর দুই কর্মী

ডাব্লিউএইচওর মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডমেয়ার গতকাল জেনেভায় জানিয়েছেন, তাঁদের দুই কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অফিস সেরে বাসায় যাওয়ার পর আমাদের ওই কর্মীদের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। পরীক্ষা করার পর তাঁদের কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এই প্রথম ডাব্লিউএইচওর কারো মধ্যে এ ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেল। এর আগে ইউরোপের একই শহরে জাতিসংঘের একজন এবং গত সপ্তাহে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একজন নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হন।

সন্দেহভাজনদের পালানো বন্ধে ভারতে ‘সিল’ মারার সিদ্ধান্ত

করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতে করোনার সন্দেহভাজন রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের মহরাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্ত, যাদের শরীরে করোনার লক্ষণ দেখা দেবে, তাদের আপাতত ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’-এর পাশাপাশি আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রাখতে বাঁ হাতে একটি বিশেষ ‘সিল’ মেরে দেওয়া হবে।

গত কয়েক দিনে ওই রাজ্যের প্রায় সাতজন করোনা লক্ষণযুক্ত রোগী চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে পালিয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে।

মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপ বলেছেন, সন্দেহভাজন রোগীদের পালানো ঠেকাতে অমোচনীয় কালি দিয়ে তাদের বাঁ হাতে একটি সিল মেরে দেওয়া হবে, যাতে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।

SHARE