আসুন গর্ববোধ করি! —–শামীমুল হক

………………………………..
আসুন আমরা গর্ববোধ করি। নিজেদের চরিত্রের জন্য, নিজেদের ব্যবহারের জন্য। আমরা গর্ববোধ করি নিজেদের চালাকির জন্য। অন্যকে ঠকাতে পারার জন্যও আসুন গর্ববোধ করি। আমরা নিজেদের স্বার্থের জন্য সব ত্যাগ করতে পারি। সেটি ভালো কি মন্দ সেটা দেখার চেষ্টাও করি না। বলতে গেলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা আমাদের সকল কৃতকর্মের জন্য গর্ববোধ করতে পারি। কবি বলেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খোঁজে পাবে নাকো তুমি। কবি যে অর্থে লিখেছিলেন সে অর্থ এখন উল্টে গেছে। তাই বলতে হয় এমন দেশটি কোথাও খোঁজে পাবে নাকো তুমি। সে যে আমার জন্মভূমি।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা। গুলিস্তান থেকে এক বৃদ্ধ মতিঝিল যাবেন। রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলেন মতিঝিল যাবে? হ্যাঁ-সূচক উত্তর পেয়ে জানতে চাইলেন কতো নিবে? রিকশাচালকের উত্তর ৬০ টাকা। কম নেবে না? রিকশাচালক বললেন, না কম হবে না। এরই মধ্যে আরেক যাত্রী এসে সেই মতিঝিলই যাবে কিনা জানতে চায়। রিকশাচালক বলেন, যাবো-৭০ টাকা লাগবে। এরই মধ্যে ওই বৃদ্ধ এসে বললেন, চলো যাই। না। রিকশাওয়ালা বেঁকে বসলেন। তিনি জানালেন ৭০ টাকা দিতে হবে। আরে তুমি না ৬০ টাকা চেয়েছো? উত্তরে রিকশাচালক বলেন, চেয়েছি কিন্তু তখন তো যাননি। এখন গেলে ৭০ টাকাই লাগবে। রিকশাওয়ালার কথা শোনে আশপাশের সবাই ‘থ’। একজন বলে উঠেনÑ এটাই বাংলাদেশ। এটাই বাংলাদেশের আসল রূপ।
এই বাংলাদেশ একদিন ছিল নদীমাতৃক দেশ। প্রতিবছর বন্যা হতো। সেই বন্যায় পলি এসে ফসলি জমিকে উর্বরা করে যেতো। যেখানে ফলতো শস্য ভাণ্ডার। নদীতে চলতো লঞ্চ, স্টিমার। চলতো বড় বড় জাহাজ। পাল তোলা নৌকা তো ছিল নদীর সৌন্দর্য। আজ কোথাও সেই দৃশ্য নেই। প্রায় সকল নদীর দু’পাড় দখল হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও নদীও হারিয়ে গেছে দখলদারদের থাবায়। দেখা যায় নদীর জায়গায় শোভা পাচ্ছে বড় অট্টালিকা। এক সময় ঢাকার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মানুষের সুপেয় পানি ছিল। এ পানির কদর ছিল আলাদা। শীতলক্ষ্যা নামের মাঝে রয়েছে এর মাজেজা। এর পানি থাকতো বার মাসই শীতল। ঠাণ্ডা। কিন্তু সেই শীতল পানির শীতলক্ষ্যা আজ সেই ঐতিহ্য হারিয়েছে। সাদা, পরিষ্কার পানি আজ দূষণে কালো হয়েছে। নদী দখল হয়ে কল-কারখানা হয়েছে। হয়েছে আলিশান বাড়িও। সেই বাড়ি ও কারখানার মালিকরা আবার গর্ব করে চলেন সমাজে। কারখানার দূষিত বর্জ্য অবলীলায় ফেলছেন নদীতে। দেখার কেউ নেই। আবার দেখতে গেলে পকেটভর্তি করে হাসি মুখে ফিরে আসে দেখনেওয়ালারা। আজ গ্রামেগঞ্জেও বদল এসেছে। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অথচ সমাজে টাকাওয়ালা লোকের সংখ্যা বেড়েছে। ছনের ঘর এখন আর দেখাই যায় না। ইটপাথরের মিশ্রণে বাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতা গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন। মনের টান। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা। এখন সবাই ছুটছে স্বার্থের পেছনে। কে কাকে ঠকাবে এ নিয়েই যেন চিন্তা। আর এসব দেখে লাজ, লজ্জা সমাজ থেকে পালিয়েছে। তাই আসুনÑ আমরা সবাই গর্ববোধ করি। এই বলে যে সমাজটা পাল্টাতে পেরেছি আমরা। এভাবে না হোক ওভাবে।
মানুষের বিবেক বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে দিন দিন। ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বানানো এখন চোখের পলকে ঘটছে। আর সেই অন্যায়কে সাপোর্ট দেয়ার মতো মানুষও আছে দলে দলে। অথচ ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে ভয় পান অনেকে। তারা নীরবে এসব দেখে যান। ক’বছর আগে হঠাৎ তরমুজ কেজি ধরে বিক্রি করতে শুরু করে খুচরা বিক্রেতারা। আশ্চর্য, অবাক করা কাণ্ড। মানুষও কেজি ধরে তরমুজ কিনছে। কেউ কেউ প্রতিবাদ জানালেও কোনো লাভ হয়নি। এই কেজি ধরে বিক্রি করে বিক্রেতারা ১০০ টাকার তরমুজ আড়াইশ’-তিনশ’ টাকা বিক্রি করতে পারছে। লাভ হচ্ছে বেশি। এ নিয়ে মাতামাতি শুরু হলে ক’দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছে। জরিমানা করেছে। কিন্তু অভিযান শেষ হলে সবই ঠিক আগের মতো চলছে। কিছুক্ষণ আগেও বাজারে দেখে এলাম কেজি ধরে বিক্রি হচ্ছে তরমুজ। এতে ১০০ টাকার তরমুজের দাম উঠছে পাঁচশ’ টাকা। অথচ পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, তারা কেজি ধরে বিক্রি করছেন না। তারা পিস হিসেবে বিক্রি করছেন। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে এসে তা কেজি ধরে হয়ে যায়। মানুষ যাবে কোথায়! এসব দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ রয়েছে। রয়েছে সরকার। কিন্তু এসব কি বন্ধ হচ্ছে? সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট নিয়ে মুখে ফেনা তুলছেন দেশের কর্তারা। কিন্তু সিন্ডিকেটের টিকিটিও এখনো ছুঁতে পারছেন না। আর পারবেনই বা কি করে? এ দেশে যে আমরা সবাই রাজা, সবার রাজত্বে। পৃথিবীর সকল দেশে কোনো উৎসব পার্বণে নিত্যপণ্যে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। বিশেষ করে রমজানে মধ্যপ্রাচ্যে ছাড় দেয়ার প্রতিযোগিতা চলে। এখানে ছাড় বললে ভুল হবে। কেনার চেয়ে অনেক কম দামে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতে ব্যবসায়ীরা অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। এতে যদি তার কিছুটা হলেও সোয়াব হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা চলে লাভ করার। কে কতো বেশি লাভ করতে পারে। কে কতো বেশি মজুত করতে পারে। আর সময় বুঝে বেশি দামে বাজারে ছেড়ে দিতে পারেÑএ চিন্তাই যেন তাদের। এ নিয়ে তারা গর্ববোধ করে। সরকার বার বার হুঁশিয়ারি ও আশ্বাস সত্ত্বেও প্রতি বছরের মতো এবারো পবিত্র রমজান মাসের আগে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। আগেই বলেছিÑ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। রমজানে মানুষকে বরং স্বস্তি দিতে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়েক হাজার পণ্যের দাম কমানো হয়েছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এরই মধ্যে বাজারে মূল্যস্ফীতি থাকায় রমজান উপলক্ষে ৯শ’রও বেশি পণ্যের দামে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। গত ৪ঠা মার্চ থেকে কার্যকর হওয়া নতুন মূল্যতালিকা রমজান মাসের শেষ পর্যন্ত চলবে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑ দুধ, দই, দুগ্ধজাত পণ্য, টিস্যু পেপার, পরিচ্ছন্নতা সরঞ্জাম, রান্নার তেল, ঘি, পনির, হিমায়িত সবজি, বাদাম, পানি, ফলের রস, মধু, ব্রয়লার মুরগি, রুটি, টিনজাত খাবার, পাস্তা, সেমাই, গোলাপ জলসহ বিভিন্ন পণ্য। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজানে প্রায় ১০ হাজার পণ্যের দাম কমানো হয়েছে। দ্য শারজাহ কো-অপারেটিভ সোসাইটি বলেছে, দাম কমানো এসব পণ্যের ৮০ শতাংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য। রান্নার তেল, আটা ও চালের মতো পণ্যের দাম ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। গত ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে এই মূল্যছাড় কার্যকর হয়েছে। ওইসব পণ্যের বাইরে থাকা পণ্যেও সাপ্তাহিক মূল্যছাড় দেয়া হবে। কেনাকাটায় ৩০০ দিরহাম বা এর বেশি অর্থ খরচ করা ক্রেতাদের জন্য থাকছে বিশেষ পুরস্কার। এ ছাড়া দান করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য ৯৯ থেকে ৩৯৯ দিরহাম পর্যন্ত তিন ধরনের খাবারের ঝুড়ি থাকবে। শারজাহ চ্যারিটির সহায়তায় এসব খাবার বিতরণ করা হবে। শারজাহ কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রধান নির্বাহী মজিদ আল জুনাইদ বলেন, ‘বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও শারজাহ কো-অপারেটিভ সোসাইটি সব শাখায় প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে। পবিত্র রমজানে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও আমরা সাশ্রয়ী মূলে পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এ ছাড়া দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন কোঅপারেটিভ চার হাজার পণ্যে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দিয়েছে।
এই বাজারের চিত্রই বলে দেয়Ñ মানুষ হিসেবে আমরা কেমন? জাতি হিসেবে আমরা কেমন? অন্যকে মেরে আমরা উল্লাস করি। অন্যকে কাঁদিয়ে আমরা হাসি। বিবেক বিক্রি হয়ে গেছে অনেক আগেই। লজ্জা, শরম সেও ধুয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের পানিতে। আমরা শুধু জানি গর্ববোধ করতে। এক টাকার পণ্য ১০ টাকায় বিক্রি করে গর্ববোধ করি। একটি ড্রেসে তিন হাজার টাকা লাভ করে গর্ববোধ করি। আমরা গর্ববোধ করি কে কতো বেশি দামে ঈদের পোশাক কিনেছে তা নিয়ে। আমরা গর্ববোধ করি কে কোন দেশে ঈদ করতে গিয়েছে তা নিয়ে। আমাদের গর্ববোধের সীমারেখা দিন দিন বাড়ছে। আসুন আমরা সবাই মিলে গর্ববোধ করি।

ভোলা নিউজ / টিপু সুলতান

SHARE