ঈদ ছোটগল্প : সোহাগী (শেষ পর্ব)

 

।। তাইফুর সরোয়ার।। 

সোহাগী শোয়া থেকে উঠে পিছনের দরজা দিয়ে দ্রুত দৌড়াতে লাগল। আমার হাতে রিভলবার ছিল। আমি রিভলবারটি ওর দিকে তাক করে ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়েও পারলাম না। কী এক অস্বাভাবিক শক্তি আমাকে ওর দিকে গুলি ছুড়তে বাধা দিল। হয়ত এই শক্তিই ছিল ওর প্রতি আমার ভালোবাসা। সোহাগী পালিয়ে গেল। ঘন কুয়াশায় ওকে আর দেখা গেল না। আমরা আবার ওকে খুঁজতে লাগলাম।

পুলিশ হিসেবে আমার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সকল আবেগকে বিসর্জন দিয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করা। আমি কখনো আমরা কর্তব্যে অবহেলা করিনি। কিন্তু সেই দিন আমি আমার দায়িত্বে নৈতিক দুর্বলতা লক্ষ্য করলাম। নিজেকে আমি বড় অপরাধী মনে করতে লাগলাম। সোহাগীর এই অভিশপ্ত জীবনের জন্য আমি নিজেকে দায়ী করতে লাগলাম। হয়ত তাকে সেদিন আমার সঙ্গে চিরসঙ্গী করে নিলে তাকে আজ এ ফেরারী জীবন বেছে নিতে হতো না।

আমি চাইনি সোহাগী ধরা পরুক। আমার সাথে ছিলো তিনজন কনস্টেবল। তারা যাতে ব্যাপারটা না বুঝতে পারে তাই আমি আরো কয়েক জায়গায় ব্যর্থ খুঁজে না পেয়ে গাড়ীতে করে পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। হঠাৎ আমাদের গাড়ির সামনে এসে সোহাগী দাড়াল। আতঙ্কে আমি শিউরে উঠলাম। অপরাধীকে হাতের এতটা কাছে পেয়ে কোন অজুহাতে তাকে আর রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠল না। আমি গাড়ী থেকে নেমে ওর কাছে গেলাম। ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। সেখানে দুঃচিন্তার লেশ মাত্র দেখতে পেলাম না। অধিকন্তু তার বাঁকা ঠোটের কোণে হাসির আভা দেখতে পেলাম। সোহাগী হয়তো প্রথমে আমাকে চিনতে পারে নি। তাই তখন পালিয়েছিল। পরে দূর থেকে চিনতে পেরে হয়ত স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল। আমি বুঝতে পারলাম না কেন সে এই বোকামীটা করল। হবে হয়ত আমার প্রতি ওর ভালোবাসার কারণে। আমি একজন কনষ্টেবলকে ঈশারায় ওর হাতে হাত করা কড়া পড়াতে বললাম। হাত কড়া পড়ানোর পর ওকে গাড়িতে উঠানো হলো। আমার তখন নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছিল। মনে হলো আমি নিজেই যেন এক খুনি। একটি মেয়ের স্বপ্নকে খুন করেছি। যার ফলে সে একজন মানুষ খুন করেছে। সমাজের চোখে সোহাগী খুনী হলেও আমার হৃদয় চোখে ও ছিল নিরপরাধ। আমার হৃদয় আদালত ওকে বেকশুর খালাস দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ যেন আমাকেই দিল।

ইন্সপেক্টর সাহেব থামলেন। কিন্তু আমার আগ্রহের শেষ নেই। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এর পর আপনি আর সোহাগীর কোন খবর নেননি? ইন্সপেক্টর সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। অনেক্ষণ পর চুপ থাকার পর আবার বলতে লাগলেন, সোহাগীকে গ্রেফতার করার পর পুরো পুলিশ মহলে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। আমাকে প্রমোশন দিয়ে বদলি করা হলো। এর পর আর সোহাগীর কোন খবর রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কয়েক মাস আগে জানতে পারলাম ওর ফাঁসির আদেশ হয়েছে।

সমীর সাহেব এই হলো আমার জীবনের স্বরণীয় ঘটনা যা আমি এর আগে কাউকে বলিনি। এখন শুধু আপনাকে বললাম। এটা আমার জীবনের এক ব্যর্থতার অধ্যায়। আর ব্যর্থতা এবং পরাজয়ের কথা প্রকাশে নিশ্চই কোন গৌরব নেই। তাই কাউকে বলিনি। ভবিষ্যতে হয়ত কাউকে বলবও না। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘরে আমি সোহাগীর সেই রহস্যময় হাসি খুব স্পষ্ট শুনতে পাই। এতটা স্পষ্ট যে মনে হয় ও আমার পাশে বসে হাসছে। ছোট বেলা থেকেই আমি যা চেয়েছি তা-ই পেয়েছি। জীবন যুদ্ধের প্রায় ক্ষেত্রেই আমার পদাচরণ ছিল বীর নায়কের ন্যায় স্বার্থক। শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই এই নায়কের পরাজয় হয়েছে।। পরাজয় হয়েছে আমার, আমার ভালোবাসার!

ভোর হয়ে এলো। পূব আকাশে কুয়াশার সাদা জাল ভেদ করে লাল সূর্যটা উঠতে লাগল। ঝন ঝন করতে করতে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ট্রেন এসে স্টেশনে থামল। স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে ট্রেনে উঠা নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হলো। ইন্সপেক্টর সাহেবও ছুটলেন আগে ট্রেনে উঠতে। ট্রেনে উঠার পর ভিড়ের মাঝে আর তাকে খুঁজে পেলাম না।

SHARE