করোনাকালে অনলাইনে লেখাপড়া : সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

।। তাইফুর সরোয়ার।।

স্বাধীনতা উত্তর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে সংকটকাল অতিক্রম করছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পরা নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। করোনার এই সংকটকালে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে এবং পাঠ্যক্রম অব্যহত রাখতে বাংলাদেশ সংসদ টেলিভিশন ও কিশোর বাতায়ন পেজে প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বনামধন্য শিক্ষকের পাঠদান কার্যক্রম। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে শিখন কার্যক্রম পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলার শিক্ষা অফিস কর্তৃক চালু করা হয়েছে ফেইসবুক লাইভ ভিত্তিক অনলাইন স্কুল। এছাড়া অনেক কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জুম, গুগল ক্লাসরুম ইত্যাদি অ্যাপ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদান করছে।

অনলাইন ভিত্তিক এই সকল শিক্ষা কার্যক্রমে শহরে প্রযুক্তি সুবিধাসমৃদ্ধ বিত্তবান শিক্ষার্থীরা উপকৃত হলেও, অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের দুষ্প্রাপ্য প্রযুক্তি সুবিধাসম্পন্ন গরীব শিক্ষার্থীরা।

দেশের শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশের পিতামাতা গরীব। এছাড়া করোনার প্রভাবে অনেক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পিতামাতার আয় কমে গেছে। এসকল পিতামাতার পক্ষে অনলাইনে লেখাপড়ার জন্য তাদের সন্তানদের কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন কিনে দেয়া প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ইন্টারনেটের ডটা কিনতে অনেক শিক্ষার্থীকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট গতি দরকার হয়, তা কেবল বড় শহরগুলোতেই সম্ভব হয়। তবে পিক সময় যেটিকে বলা হয় মানে অফিস সময়ে, অনেক ক্ষেত্রেই ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরে বসেও সভা বা ক্লাসে যুক্ত হতে সমস্যা হয়। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেট সংযোগের কচ্ছপ গতির কথা না–ই উল্লেখ করলাম। যাদের স্মার্টফোন নেই কিংবা থাকলেও নেটওয়ার্কের দুর্বলতা বা ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করার মতো অবস্থায় নেই, তারা ক্লাস করতে না পারায় পিছিয়ে পড়বে বলেই অভিযোগ করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবও একটা বড় সমস্যা। আমাদের অনেক শিক্ষক বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অনেকেরই তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই। তাই তারা অনলাইনে ক্লাস নিতে অনিহা প্রকাশ করে। কর্তৃপক্ষের চাপে অনেক শিক্ষক ক্লাস নিলেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে অধিকাংশ শিক্ষকের ক্লাস ফলপ্রসূ হয় না। অনলাইনে লেখাপড়ার কথা বলে অনেক শিক্ষার্থী স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে গেম খেলে, ফেসবুকিং করে এবং আপত্তিকর বিভিন্ন সাইটে প্রবেশ করে। এতে তাদের চারিত্রিক ও নৈতিক অধপতনের সাথে সাথে নষ্ট হচ্ছে জীবনের মূল্যবান সময়।

করোনার এই সংকটকাল কবে শেষ হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। করোনাকে সঙ্গে নিয়ই আমাদের কাটানো লাগতে পারে আরো কয়েকটি মাস, এমনকি বছরও। তাই শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় সংযুক্ত রাখতে অনলাইনে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই।

সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এই বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতি মালা তৈরি করা জরুরী। অনলাইনে লেখাপড়ার জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইন্টারনেট এখন আর কোনো বিলাসী সেবা নয়। শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইনে ক্লাস নেয়ার জন্য দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অনলাইনে লেখাপড়ার কথা বলে অনেক শিক্ষার্থী স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে গেম খেলে, ফেসবুকিং করে এবং আপত্তিকর বিভিন্ন সাইটে প্রবেশ করে যেন জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে সেই দিকে অভিভাবকসহ সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। করোনা ভাইরাসের কারনে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখতে অনলাইনে লেখাপড়া একটি অপরিহার্য পদ্ধতি। এই পদ্ধতির সর্বচ্চো সুফল পাওয়ার জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত সঠিক পদক্ষেপ।

SHARE