প্রিয়_ভোলা_জেলার_ইতিহাস_ও_ঐতিহ্য!!!

মোঃ ইমরান হুসাইন মুন্নাঃ-

১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গোপসাগরের মাঝে বিশাল একটি চরের উত্থান হয়। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সেই চরে লোকজন বসতি শুরু করতে থাকে। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা দ্বীপটি দখল করে ঘাঁটি স্থাপন করে। ঐ সময় সম্রাট আকবরের অন্যতম সেনাপতি শাহবাজ খান মগ বর্তমান দৌলতখানে একটি দূর্গ স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারে সুবেদারি আমলে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় শাহবাজপুর। কালের বিবর্তনে পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে ভোলা রাখা হয়। ৩৪০৩.৪৮ বর্গ কি.মি. আয়তনের দ্বীপটি ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক জেলা হিসাবে পথচলা শুরু করে এবং সাম্প্রতিক সময়ে “কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ” উপাধি পায়।
বাংলাদেশের সবেচেয়ে বড় দ্বীপ এবং একমাত্র দ্বীপজেলা ভোলার উত্তরে ও পূর্বে মেঘনা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তর-পূর্ব কোণে ইলিশা, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে শাহাবাজপুর এবং পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী বহমান।

ভোলার নদী পথ অনেকটা এলাকা জুড়ে বিস্তৃর্ণ। ভোলা জেলার আভ্যন্তরীণ নৌ-পথগুলো ছাড়াও রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি নৌ-রুট। প্রত্যেকটি রুটের’ই রয়েছে নিজস্ব নৌযান এবং নিজ নিজ রুট স্বকীয়তা। যার ফলে স্থানীয় লোকজন নিজ নিজ এলাকা হতে রাজধানী ঢাকা অথবা নির্দিষ্ট গন্তব্যপথ পাড়ি দিতে পারছে খুব সহজেই।

ভোলা জেলার উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্ববহ নৌ-পথগুলো হলো,
ভোলা – ঢাকা : ভোলা লঞ্চঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে কোন প্রকার বিরতি ছাড়া ১৯৫ কি.মি. নদীপথ সরাসরি পাড়ি দিয়ে ঢাকা নদী বন্দরে পৌঁছানোর মাধ্যমে এ রুটের নৌ-যানগুলো যাত্রার সমাপ্তি করে। দ্রুতগামী, মানসম্মত সেবা ও বিলাসবহুলতার চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয় ভোলা – ঢাকা’র নৌ-যানগুলোকে। এ রুটের নৌ-যানগুলো হলো, এম.ভি ভোলা, সম্পদ, বালিয়া, দিঘলদী, কর্ণফুলী-৯, ১০ ও ১১ এবং গ্লোরি অব শ্রীনগর-৭। বলতে গেলে, ভোলার প্রায় সব লোকই যাতাযাতের মাধ্যম হিসেবে নৌ-পথকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ফলে ভোলাবাসীর যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে নৌ-যানগুলো অনেকটাই আস্থার প্রতীক।
বলা বাহুল্য, ভোলা কলঘাট এলাকায় একসময় স্টিমারঘাট ছিল। নদী ছোট হওয়ার মিছিলে হারাতে হয়েছে সেই ঐতিহ্য। যা এখন কেবল ধুলোপরা ইতিহাসের সাক্ষী।

দৌলতখাঁ – ঢাকা : দৌলতখাঁ – ঢাকা রুটের নৌ-যাগুলো যাত্রা শেষ করে ১৭৯ কি.মি. নৌ-পথ পাড়ি দেবার মাধ্যমে। পথের মাঝে তুলাতলি, কাঠিরমাথা, দাশেরহাট, বিশ্বরোড, বঙ্গেরচর, মল্লিকপুর, কালিগঞ্জ ঘাটগুলো ধরে ঢাকা যায়। এ রুটে যে সব পণ্যের চালান ঢাকায় পাঠানো হয় তার মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ অন্যতম। তবে ইলিশ মাছের চালান সর্বাধিক। পণ্যের চালান ও যাত্রীর কলরবে বেশ জাকজমকপূর্ণ নৌ-রুটে পরিণত হয়েছে দৌলতখাঁ – ঢাকা রুট। এ রুটের নৌ-যানগুলো হলো কর্ণফুলি -১, এম.ভি ফ্লোটিলা, টিপু এবং ফারহান।

বেতুয়া (চরফ্যাশন) – ঢাকা : এই রুটটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও জনপ্রিয় রুট। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি অন্যদের কাছেও দিনদিন রুটটি বেশ পছন্দের হয়ে উঠছে। বিশেষ করে পর্যটকদের কাছে। বেতুয়া (চরফ্যাশন) হতে এ নৌরুটের নৌযানগুলো পর্যায়ক্রমে হাকিম উদ্দিন, সরাশগঞ্জ, মির্জাকালু, তজুমদ্দিন, শশীগঞ্জ, সি-ট্রাক ঘাট, মঙ্গল সিকদার ঘাট হয়ে ২৪৬কি.মি. সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার মাধ্যমে যাত্রা শেষ করে। এ রুটে চলাচলকারী লঞ্চ এম.ভি ফারহান-৫ ও ফারহান-৬ বৃহদাকার এবং আধুনিক মানের। ব্যবসায়িক পণ্য এবং ইলিশ মাছের পাশাপাশি মৌসুমভেদে তরমুজ, শশা, সুপারি, পান, শুঁটকি, নারিকেল রাজধানীতে পাঠানো হয় এ রুটের নৌযানগুলোতে।

হাতিয়া – মনপুরা – ঢাকা : এই নৌ পথটি জনবহুল ও জনপ্রিয় রুটের মধ্যে অন্যতম। এর প্রধান কারণ, ভোলা জেলার মূল ভূ-খন্ড হতে বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বীপ মনপুরার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা নৌযান। হাতিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে মনপুরা, কালিগঞ্জ, বিশ্বরোড, দৌলতখাঁ, হাকিমউদ্দিন, সরাশগঞ্জ, মির্জাকালু, তজুমদ্দিন ঘাট দেয়া শেষে রাজধানি ঢাকা যায় ২৩৩ কি.মি. নদী পথ পাড়ি দিয়ে। এ রুটের চলাচল করে আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন নৌ-যান ফারহান-৩ এবং ফারহান-৪। অন্যান্য রুটের মত এ রুট দিয়েও সব ধরণের পণ্য, মালামাল আনা নেয়া করা হয়। সাথে ইলিশ ও অন্যান্য প্রজাতির মাছতো আছেই।
বলে রাখা ভালো, হাতিয়া মূলত নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বেশ কয়েকটি উপকূলীয় দ্বীপ নিয়ে গঠিত নদীবেষ্টিত একটি উপজেলা। যার মধ্যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের দ্বীপ হিসেবে পরিচিত নিঝুমদ্বীপ অন্যতম। কাজেই নদীবেষ্টিত জনপদ হওয়ায় এখানকার মানুষের অন্যতম পছন্দের নৌ-রুট এটি।

হাজীরহাট (মনপুরা) – চাঁদপুর – ঢাকা : খুব বেশিদিন হয়নি এ রুটে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। এ জনপদের মানুষ আগে মনপুরা দিয়ে রাজধানীতে যাতায়ত করতো। এতে তাদের সময় নষ্টসহ অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো। তাইতো ব্যবসায়ি এবং যাত্রী সাধারণের সুবিধার কথা বিবেচনা করে নতুন এ রুটটি চালু করা হয়েছে। অল্পদিনে ঢাকা – হাজীরহাট রুটটি বেশ জনপ্রিয় রুটের একটি হয়ে উঠেছে। হাজীরহাট থেকে যাত্রা শুরু করে রামনেওয়াজ, তজুমদ্দিন, মির্জাকালু, সরাশগঞ্জ, হাকিমদ্দিন, দৌলতখাঁ, লুদুয়া, মতিরহাট, বিশ্বরোড, কালিগঞ্জ ঘাট ধরে ঢাকা সদরঘাটে পৌঁছে দীর্ঘ যাত্রার ইতি টানে। এ রুটের লঞ্চ এম.ভি টিপু-৫ এবং পানামা। এখান দিয়েও একই ধরণের পণ্য আনা-নেয়া করা হয়।

ঘোষেরহাট – নাজিরপুর – ঢাকা : এ রুটটি বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয় বলা যায়। ২০৭ কি.মি. সু প্রসারিত এই নৌ-পথটি পাড়ি দিতে নৌ-যানগুলো ফতুল্লা, ধুলিয়া, দেউলা, দেরীরচর, কচুখালি, গজারিয়া, পাংগাশিয়া লঞ্চ ঘাটের পল্টুনগুলো ধরে ছুটে চলে ঢাকা নদী বন্দরের দিকে। এখান দিয়েও সব ধরণের পণ্য, মালামাল আনা-নেওয়া করা হয়, সাথে শুঁটকিও। কর্ণফুলি -৪, সাব্বির, শাহরুখ, প্রিন্স অব রাসেল এ রুটের অন্যতম জনপ্রিয় নৌযান।

লালমোহন – ঢাকা : লালমোহন – ঢাকা নৌপথের ব্যাপ্তি ২০১ কি.মি.। এতটা দীর্ঘ পথের মধ্যে নৌযানগুলো নাজিরপুর, দেবীরচর, ভেরীর মাথা, ফরাসগঞ্জ ঘাটে নির্দিষ্ট সময় যাত্রা বিরতি করে থাকে। যাত্রী, ব্যাবসায়িক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের চালান করা হয় উক্ত নৌপথের মাধ্যমে। কাজেই বেশ জমজমাট রুট এটি। এই রুটের নৌযান গ্লোরি অব শ্রীনগর-৩ ও কর্ণফুলী-৩ দু’টোই বিলাসবহুল।

লেতরা – ঘোষেরহাট – ঢাকা : ২০৭ কি.মি. দীর্ঘ এ নৌ রুটটি বর্তমানে পরিচিত রুটের একটি। এ রুটের নৌযানগুলো ধুলিয়া, দেবীর চর, দেউলা, নাজিরপুর, গজারিয়া, চর কলমি, বোয়ালখালি, বকসি ভায়া ঘাট ধরে রাজধানী ঢাকা গিয়ে যাত্রার সমাপ্তি করে। এখান থেকেও শুঁটকির চালান যায়। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যতো আছেই। চলাচলকারী নৌ-যান জামাল-১ এবং জামাল-৩।

বোরহানউদ্দিন – গঙ্গাপুর – ঢাকা : এ রুটের চলাচলকারী নৌযানগুলো গঙ্গাপুর, ধুলিয়া, মাঝিরহাটের পথ ধরে ১৯৮ কি.মি. দীর্ঘ নৌ-পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা নদী বন্দর পৌঁছায়। বন্ধন-৭, রণদূত প্লাস, গাজী সালাউদ্দিন, জাহিদ-৭ এ রুটের মানুষের কাছে বেশ পছন্দের নৌযান।

এবার আসি ভোলা নৌ-পথের ডুবোচর ও নাব্যতা সংকট বিষয়ে। ভোলা নৌ-পথে বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে, রয়েছে কিছু সরু চ্যানেল ও ডুবোচর এলাকা। এসব এলাকা দিয়ে শুকনো মৌসুমে নৌ-যান চলাচল বেশ কষ্টসাধ্য এবং দুর্বিসহ বটে। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে ভোলা টার্মিনাল হতে ভেদুরিয়া চ্যানেল, লালমোহনের সরু নদী, বোরহানউদ্দিন সরু চ্যানেল, নাজিরপুর ঘাটের প্রবেশ দ্বার, সাতবাড়িয়ার ঘোল, চোটকির ঘোল ইত্যাদি। এছাড়াও তেঁতুলিয়া নদীতে রয়েছে বেশ কিছু অদৃশ্য ডুবোচর আর এই ডুবোচরে আটকে দূর্ভোগের শিকার হচ্ছে ভোলা, লালমোহন, চরফ্যাশন, নাজিরপুর ও ঘোষেরহাট রুটের যাত্রীরা। তজুমদ্দিনের বাদশামিয়ার চর, ইলিশার কালুর চর, দেউলিয়ার ঘাট, ভেরীর মাথায়ও রয়েছে এ রকম একই সমস্যা। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নেই বিকন বয়া বাতি। যার ফলে মাস্টারদের কিছুটা অনুমান করে চালাতে হচ্ছে নৌযান। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে নাজিরপুর ঘাট সংলগ্ন এলাকায় এম.ভি কোকো-৪ নৌযানটি ডুবে যাওয়ার ফলে সেখানের আসে পাশে ব্যাপক পলি পরায় ব্যাহত হচ্ছে নৌ-যান চলাচলে।
আমরা এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ, নদী বাঁচলেই তো বেঁচে থাকবে নৌপথ। দূর হবে সমস্যা।

চাইলে আপনি ও ঘুড়ে আসতে পারেন সমগ্র ভোলার নৌ-রুট বা আপনার পছন্দের নৌ-রুট। উপমহাদেশের সর্বোচ্চ ওয়াচ টাওয়ার (চরফ্যাশন), শাহাবাজপুর গ্যাস ফিল্ড (বোরহানউদ্দিন), দেশের দ্বিত্বীয় সুন্দরবন খ্যাত চর কুকরিমুকরি (চরফ্যাশন), প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি মনপুরার দুরন্ত হরিণপাড়া, জাতীয় মঙ্গলের কবি মোজাম্মেল হক, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী আজন্ম বিপ্লবী কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড নলিনী দাস এবং শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামালের এই জেলা শহর আপনার তৃপ্ততা বাড়িয়ে দিবে কয়েক গুণ….

নৌ-পথ যুগ যুগ তার যৌবন ধরে রাখুক। ধরে রাখুক নদী তার নিজস্ব ধারা, সেই ধারার সাড়ার টানে বেঁচে থাক সমগ্র ভোলার নৌ-পথের ঐতিহ্য, ইতিহাস সভ্যতা ও পুরানো জৌলুস…!

SHARE