করোনাভাইরাসঃ আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

তাইফুর সরোয়ার-

করোনাভাইরাস, যার পোশাকি নাম কোভিড-১৯। বর্তমান বিশ্বের নতুন আতঙ্কের নাম এই করনা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে এই ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফোর হিসাব অনুযায়ী, গত কাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৬৭ হাজার ২৯৩। এর মধ্যে ছয় হাজার ৪৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে ৭৬ হাজার ৫৮৮ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে – আতঙ্ক নয়, সচেতনতা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তি মিলাত পারে করনা ভাইরাস থেকে।

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। প্রাথমিক সময়ে একটা আজানা ভাইরাস উহানের সি ফুড মার্কেটে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে শনাক্ত হয়। তারপর করোনাভাইরাস উহানে মারাত্মক অবস্থা ধারণ করে এবং চীনের উহানসহ অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। চীন সরকার করোনাভাইরাসকে প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে।

চীন উহান শহরকে অন্যান্য দেশ এবং প্রদেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে লকআউট করেছিল, যার কারণে বেইজিংসহ অন্যান্য প্রদেশ তেমন আক্রান্ত হয়নি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। চীন সরকার কয়েকটি সরকারি জিমনেসিয়াম, প্রদর্শনীকেন্দ্র ও ইনডোর স্টেডিয়ামকে হাসপাতালে রূপান্তর করেছিল। ছয় দিনে ১০০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। সব পরিবারের খাবার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকেরা, এমনকি একই পরিবার থেকে সপ্তাহে একজন বা একই কমিউনিটি থেকে দুই থেকে পাঁচজন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহের জন্য বের হতে পারত। সবাইকে ঘরে বা বাড়িতে আবদ্ধ থাকতে হতো। তেমনি চিকিত্সক, সেবাকর্মী, সেনা ও পুলিশ বাহিনীর লোকজন এবং স্বেচ্ছাসেবীদের কার্যক্রম ছিল লক্ষণীয়। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকে উহানের করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে। চীন সরকারের আরো উদ্যোগের মধ্যে ছিল বিমানে ভ্রমণকারী যাত্রীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা। তারা আইন করেছিল, মাস্ক ব্যতীত কেউ বাইরে যাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।

এ রকম কঠোর পদক্ষেপের ফলে করনার উৎপত্তি স্থান চীনের উহান শহরে স্বস্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাস উৎপত্তির শুরুতে উহানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রতিদিনে এক হাজার। এখন তা ২০-২৫ জন। গত ১০ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং চীনের উহান শহর পরিদর্শন মধ্য দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উহানে ১৬টি অস্থায়ী হাসপাতাল ছিল, যার ১১টি গুটিয়ে নিয়েছে চীন কর্তৃপক্ষ। স্কুল, কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। চিকিৎসাধীন আক্রান্তদের মধ্যেও মৃত্যের সংখ্যা কমে আসছে। এরই মধ্যে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে অন্তত ২২ জনে। এটা ৬ জানুয়ারি থেকে আজ অব্দি সর্বনিম্ন। এ পর্যন্ত চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় তিন হাজার ২০০ এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৭৯৩। অর্থাত্ চীনে মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার সংখ্যা ৬২ হাজার ৭৯৩, যার হার ৮০ শতাংশ। সুতরাং করোনা নিয়ে বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, দরকার সচেতনতা। চীনে করোনাভাইরাসে মহামারি শুরুর সময় যতটা তীব্র ছিল, এখন ধীরে ধীরে কমে আসছে, এটা বিশ্বের জন্য ইতিবাচক।

বাংলাদেশেও এ পর্যন্ত আট জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। মানিকগঞ্জ, ঝিনাইদহ, ভোলাসহ বিভিন্ন জেলায় এ পর্যন্ত ২৩১৪ জন মানুষকে হোম কোয়ারেন্টাইনেো রাখা হয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বর্তমানে ২৬ জেলায় এ কার্যক্রমের কথা শোনা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে করনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার বেশি হলেও মৃত্যুর হার কম হওয়ায় আতঙ্কিত না হয়ে, বৃদ্ধি করতে হবে জন সচেতনতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে কিছু উপদেশ দিচ্ছে। আসুন, জেনে নেওয়া যাক।

১. নিয়মিত এবং ভালো করে বারবার অন্তত ২০ সেকেন্ড যাবৎ হাত ধোয়া।

২. যেকোনো সর্দি–কাশি, জ্বর বা অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত এক মিটার বা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা।

৩. অপরিষ্কার হাত দিয়ে কখনো নাক–মুখ–চোখ স্পর্শ না করা।

৪. কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় নাক, মুখ রুমাল বা টিস্যু, কনুই দিয়ে ঢাকা। টিস্যুটি ঠিক জায়গায় ফেলা।

৫. অসুস্থ হলে ঘরে থাকা, বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা।

৬. মাছ, মাংস, ডিম ভালো করে সেদ্ধ করে রান্না করা। অসুস্থ প্রাণী কোনোমতেই খাওয়া যাবে না।

৭. জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকা এবং অন্য দেশ থেকে প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা।

৮. আক্রান্ত দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা প্রবাসীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা।

৯. কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ড শেক), কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা।

১০. এ সময়ে কোনো কারণে অসুস্থ বোধ করলে, জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসক / স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্য নেয়া। অথবা আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করা। আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বর: ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১ এবং ০১৯৩৭১১০০১১।

তথ্য সূত্র- বিবিসি বাংলা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কন্ঠ, আনন্দ বাজার পত্রিকা এবং ইন্টারনেট

SHARE