বাবার সামনেই বাস পিষে মারলো আবরারকে

বিশেষ প্রতিনিধিঃ
প্রগতি সরণি সড়কের পূর্বদিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেট,পশ্চিমে নবনির্মিত বহুতল আইকন সেন্টার। পূর্বদিক থেকে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি)’র ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বাবা। পুত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে তোলে দিতে সড়ক পর্যন্ত এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই বাবার সামনেই পুত্রকে কেড়ে নিলো ঘাতক বাস। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাসটি আবরারের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা পথ।

তারপরই আশপাশের লোকজন ও শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। আটক করা হয় সুপ্রভাত পরিবহনের বাস ও বাস চালককে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তায় খুব বেশি যানবাহন ছিল না তখন।

পশ্চিম পাশে আইকন সেন্টারের সামনে থেকে আবরারের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠার কথা ছিল। বাসে উঠতেই রাস্তা পার হচ্ছিলেন তিনি। পিছু পিছু আসছিলেন তার পিতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরী। নিজ চোখে ছেলের করুণ মৃত্যুর দৃশ্যটি দেখলেন হতভাগ্য এ পিতা। বেপরোয়া সুপ্রভাত বাসটি সন্তানের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলো। মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখেছে আবরারের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, সহপাঠীরাও। আইকন সেন্টারের নিরাপত্তা কর্মী হোসাইন জানান, ‘মাগো…’ বলে চিৎকার করেছিল ছাত্রটি। তারপর আর কোনো শব্দ নেই। রক্তে লাল নিথর দেহটি পড়েছিল সড়কে। আহত হন বাবা আরিফ আহমেদ চৌধুরীও। তিনি তখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গোলাম কিবরিয়া জানান, সুপ্রভাত বাসটি বেপরোয়া গতিতে চলছিল। তার পেছনে আরো কয়েক বাস। সবাই যেন প্রতিযোগিতা করছিল। এর মধ্যেই সুপ্রভাত বাসের সামনের চাকা আবরারের মাথা পিষ্ট করে দেয়। পাশেই ছিল ট্রাফিক পুলিশ। বেপরোয়া বাসের গতি, যততত্র বাস থামানো নিয়ে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। বাসের দিকে তাদের কোনো নজর নেই। তারা ব্যস্ত ছিলেন মোটরসাইকেল থামিয়ে মামলা দিতে। একই অভিযোগ করেন আবরারের বন্ধু-সহপাঠীরাও।
বিইউপি’র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের ছাত্র জামিল হোসেন চৌধুরী রাহাত জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বাস ওই রুট দিয়ে মিরপুরের ক্যাম্পাসে যাতায়াত করে। মালিবাগের মৌচাক থেকে একটি এবং রামপুর ব্রিজ থেকে দুটি। মৌচাক থেকে বিইউপি’র ছয় নম্বর বাসে উঠেছিলেন রাহাত। ওই বাস থেকেই আবরারের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন তার ব্যাচমেট নিশাত। বাসে উঠার জন্যই নিশাতের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন আবরার। নিশাত তাকে বলেছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটি বসুন্ধরা গেটের সামনে যাবে। চলে এসো।

রাহাত বলেন, ওই বাসটি সেখানে পৌঁছার আগেই সবকিছু শেষ করে দিয়েছে সুপ্রভাত নামক বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি থামার পর দেখা গেলো আবরারের রক্তাক্ত লাশ একটি ভ্যানে তোলা হয়েছে। পাশে কয়েক পুলিশ সদস্য এবং আমাদের ভাই-বোন, বন্ধুরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত রাস্তায় বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে।

আবরারের বন্ধু-সহপাঠীরা জানান, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন আবরার। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ স্লোগান সম্বলিত একটি ছবিও পাওয়া গেছে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সড়ক দুর্ঘটনাতেই তার মৃত্যু হলো। তাও তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে ট্রাফিক সপ্তাহ চলাকালে। গত ১৭ই মার্চ থেকে মোড়ে মোড়ে চলছে ট্রাফিক পুলিশের তল্লাশি। এর মধ্যেই আবরারের প্রাণ কেড়ে নিলো বাস। আবরারের পারিবারকি সূত্রে জানা গেছে, আবরার একজন ভালো চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশও নিয়েছিলেন। কিন্তু মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পেয়ে ভর্তি হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। তারপরও স্বপ্ন পূরণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আবারও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার ইচ্ছে ছিল তার। আদরের ছেলেটিকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যান মা-বাবা।

বনানী কবরস্থানে আবরারকে দাফনের আগে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার মা ফরিদা ফাতেমি। তিনি বারবার বলছিলেন, বাবা, তুমি এভাবে আমাকে রেখে চলে গেলে। মাকে রেখে চলে যেতে হয় না বাবা। তোমাকে একা কোথাও যেতে দিতাম না। তুমি আমাকে বলতে আম্মু তুমি যদি আমাকে একা চলাফেরা করতে না দাও, তবে আমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হবো কিভাবে? এখন আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো বাবা…।’ ছেলেকে দাফন করার পর দীর্ঘ সময় নির্বাক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহামেদ চৌধুরী। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ছেলেকে কবর দিয়েছি, এরচেয়ে বড় কষ্টের কিছু নেই।

কুর্মিটোলা হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আবরারের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এডিবি গ্রেড গ্রাউন্ড মাঠে। সেখানে জানাজা শেষে বনানী সামরিক করবস্থানে আবরারের লাশ দাফন করা হয়। এ সময় পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরিফ আহমেদ চৌধুরী ও ফরিদা ফাতেমি দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে বড় আবরার আহমেদ চৌধুরী। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পাস করে বিইউপিতে পড়ছিলেন। ছোট ছেলে আবিদ আহমেদ চৌধুরী একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বসুন্ধরা ডি ব্লকে একটি বাসায় থাকেন তারা। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবি সিদ্দিক বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। সেইসঙ্গে সুপ্রভাত বাস জব্দ ও বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাসচালক সিরাজুল ইসলাম (২৯) বরিশাল সদরের চরবুখাইন গ্রামের আবুল কালামের পুত্র।

SHARE