সহিংসতার বৃত্ত ভাঙছে রাজনীতি

অনলাইন ডেস্ক:

১৯৯১ সালের পর প্রতিবার জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাপক হাঙ্গামা, সহিংসতা, রাজপথে কর্মসূচি হলেও এবারের পরিস্থিতি পুরো উল্টো। যদিও আশঙ্কা ছিল, বিরোধী পক্ষ শক্তি লড়াইয়ে নামবে, কিন্তু তারা এখন ভোটের প্রস্তুতিতে।

রাজনীতিতে এই পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। নির্বাচন-প্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা ফিরে আসবে বলে আশাবাদী তারা।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের মানুষ আসলে হরতাল-অবরোধ কখনোই পছন্দ করত না। রাজনৈতিক দলগুলো কখনো কখনো সেগুলো মানুষের ওপর চাপিয়ে দিত। তবে এবার রাজনীতিবিদদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আমরা লক্ষ করছি। তারা হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা তাদের ম্যাচিউরিটির প্রমাণ দিচ্ছেন। কারণ আমরা এর আগে দেখেছি নির্বাচন এলেই হরতাল-অবরোধ হতো। দেশের অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। ফলে আমাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর হতো। কিন্তু এবার সেটি হচ্ছে না। এতে আমাদের অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেবল আমরা দেশি ব্যবসায়ীরাই লাভবান হচ্ছি না, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আমাদের দেশে আসছেন, বিনিয়োগ করছেন। এটি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় বিষয়।

গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশে হরতাল-অবরোধ হয়নি বললেই চলে। অর্থনীতির চাকা ঘুরেছে প্রায় নির্বিঘ্নে আর এতে খেটে খাওয়া মানুষদেরও পড়তে হয়নি বিপাকে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর। আর রাতেই ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডাকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট, পরে যা ৭২ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকে। আর এই তিন দিনে ব্যাপক সহিংসতায় প্রাণ হারায় ২১ জন।এরপর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টানা হরতাল-অবরোধের ফাঁদে পড়ে দেশ। নিহত শতাধিক মানুষ।

শুধু গত নির্বাচনই নয়, ১৯৮৬ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হরতাল-অবরোধ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রাণ হারিয়েছে অগুনতি মানুষ।

১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকা টানা অবরোধে দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই বিএনপি সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা ভোট করে ক্ষমতায় ফেরে। যদিও তারা দেড় মাসের মধ্যেই পদত্যাগ করে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করে।

ওই বছরের ১২ জুন আরেক দফা ভোট হয়, যদিও সেটাও নির্বিঘ্ন ছিল না। ভোটের আগে আগে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হয়। যদিও পরে সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান তা সামাল দেন।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও এর আগে দুই বছর সরকার পতনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে জোট গড়ে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যায় তারা।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনের আগেও ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। বিচারপতি কে এম হাসানের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বিষয়টি মানতে চাইছিল না আওয়ামী লীগ ও তার জোট। তাদের অভিযোগ, বিএনপির সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এই সরকারের উপদেষ্টা হলে সেটি বিএনপিরই সরকার হয়।

সে সময় নির্বাচন কমিশন যোগ্য ভোটারদের বাদ দিয়ে ব্যাপকভাবে ভুয়া ভোটার করে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসে।

এ নিয়ে ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জারি হয় জরুরি অবস্থা। দুই বছর থাকে ওই সরকার। এই সরকারের আমলে ছবিসহ জাতীয় পরিচয়পত্র করার পর দেখা যায়, আগের তালিকার চেয়ে ভোটার কমে গেছে এক কোটি ২১ লাখ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন-পদ্ধতি ফিরিয়ে আনে সরকার। কিন্তু মেনে নিতে রাজি ছিল না বিএনপি এবং তার মিত্ররা। ২০১৩ সালের শেষ দিকে আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতায় প্রাণ যায় পাঁচ শতাধিক মানুষের।

রক্তক্ষয়ী সহিংসতার মধ্যেই ভোট হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এবারও দাবি মানা না হলে আন্দোলনের হুমকি ছিল বিএনপির। তবে এবার আর সেই পথে হাঁটেনি তারা।

তবে বিএনপি ভোটে আসার ঘোষণা দেওয়ার পর একদিন সংঘর্ষ হয়েছে। যদিও দলীয় কার্যালয়ের সামনে ওই মারামারি আর ছড়ায়নি। এর আগে ভোটের মৌসুমে এ ধরনের সহিংসতা অন্যত্র ছড়িয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশ এক নতুন ইতিহাসের দিকে মোড় নিচ্ছে। সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসছে রাজনীতি। দেশের মানুষও এখন হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি গ্রহণ করছে না। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোও সেদিকটি বিবেচনায় নিতে বাধ্য হচ্ছে। এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধ এখন আর মানুষ পছন্দ করে না। সেটা রাজনৈতিক দলগুলো বুঝে গেছে। সে কারণেই তারা বিকল্প কর্মসূচি দিচ্ছে।’

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আসলে এখন আর শক্তি প্রয়োগ করে দাবি আদায় করা যায় না। একটা সময় ছিল যখন চাপ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দাবি আদায় করত। হরতাল দিত, অবরোধ দিত। কিন্তু এখন আর সেটি হচ্ছে না। এখন সবকিছু নির্ভর করবে জনগণের ওপর।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘হরতাল-অবরোধ নেই। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসতে হবে। সেটি মনে হয় শুরু হয়েছে।’

কোন আমলে কত হরতাল

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন পর্যন্ত দেশে জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে মোট হরতাল হয়েছে ৪০৯ দিন।

অন্যদিকে এরশাদ সরকারের পতনের পর চারটি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে দেশে মোট হরতাল হয়েছে ৯৩২ দিন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর মুজিব সরকারের আমলে (১৯৭২-১৯৭৫) মোট ২২ দিন হরতাল হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয়ভাবে ৫ দিন, ঢাকায় ও আঞ্চলিক হরতাল ৫ দিন ও স্থানীয় পর্যায়ে ১২ দিন হরতাল হয়েছে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর খন্দকার মোশতাক, জিয়া ও সাত্তারের আমলে (১৯৭৫-১৯৮২) মোট হরতাল হয়েছে ৫৯ দিন। এর মধ্যে জাতীয়ভাবে ৬ দিন, ঢাকায় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ৯ দিন ও স্থানীয় পর্যায়ে ৪৪ দিন হরতাল হয়েছে।
এরশাদ সরকারের আমলে (১৯৮২-১৯৯০) দেশে মোট হরতাল হয়েছে ৩২৮ দিন। এর মধ্যে জাতীয়ভাবে ৭২ দিন, ঢাকায় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ৫৬ দিন ও স্থানীয় পর্যায়ে ২০০ দিন হরতাল হয়েছে।

এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি।

বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে ৮১ দিন, ঢাকা ও আঞ্চলিকভাবে ৬৯ দিন, স্থানীয়ভাবে ২৬৬ দিনসহ মোট ৪১৬ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। ওই সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করেছে বলে দাবি করা হলেও সংবাদপত্র ঘেঁটে এই দাবির সত্যতা মেলেনি বলে পিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে মোট হরতাল হয়েছে ২৮৩ দিন। এর মধ্যে জাতীয়ভাবে ৪৫ দিন, ঢাকা ও আঞ্চলিকভাবে ৪৭ দিন, স্থানীয়ভাবে ১৯১ দিনসহ মোট ২৮৩ দিন হরতাল হয়েছে। এ সময় বিরোধী দল বিএনপি জাতীয় পর্যায়ে সারা দেশে ৫৯ দিন হরতাল করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ ১৩০ দিন হরতাল করেছে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে (২০০৯-২০১৩) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ৩৫ দিন হরতাল ও শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন বাতিলের দাবিতে টানা প্রায় দুই মাস (৬০ দিন) অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।

(আল-আমিন এম তাওহীদ, ২৪নভেম্ববর-২০১৮ইং)

SHARE