২৫গ্রাম মাদক পেলেই মৃত্যুদণ্ড

অনলাইন ডেস্ক:

মাদক নিয়ন্ত্রণে নতুন একটি বিল পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে যেখানে ২৫ গ্রাম মাদক পেলেই যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা বলা আছে। বিলটিকে নিষ্ঠুর, অমানবিক বলেছেন সংসদে বিরোধী দলের একজন সদস্য।

বিলে ইয়াবা ৫ গ্রামের কম হলে এক থেকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ইয়াবার পরিমাণ ৫ গ্রামের বেশি হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

আইনে কোনও ব্যক্তি কোনও অপরাধ সংঘটনে কাউকে প্ররোচনা দিলে, সাহায্য করলে বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তারও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ, সরবরাহ, মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা করলেও একই শাস্তি পেতে হবে।

এতদিন সিসাকে মাদক হিসেবে ধরা না হলেও নতুন আইনে সিসাবারকেও আইনের আওতায় আনার কথা বলা আছে।

বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য বিলটিকে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করলেও তা কণ্ঠভোটে নাচক হয়। পরে একজন সংসদ সদস্য শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের সাজার বিধান বাতিলের দাবি জানালে সেটিও অগ্রাহ্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। আর কণ্ঠভোটে পাস হয় বিলটি।

গত ৮ অক্টোবর ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’ এর খসড়ায় সায় দেয় মন্ত্রিসভা। ২২ অক্টোবর বিলটি তোলা হয় সংসদে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বিলটি উত্থাপন করলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুই দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

মাদক নিয়ন্ত্রণে আগের আইনটি ছিল ১৯৯০ সালে। সেই আইনে ইয়াবার কথা উল্লেখ ছিল না, যদিও বর্তমানে ইয়াবাতেই আসক্তি বেশি মাদকাসক্তদের মধ্যে। বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না থাকলেও এটি ৭০ লাখ বলে ধারণা করা হয়, এদের ৫০ লাখই ইয়াবায় আসক্ত।

মাদক নিয়ন্ত্রণে নতুন আইনটি এমন এক সময়ে পাস হলো যখন মাদকের বিরুদ্ধে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। গত মে থেকে শুরু করা এই অভিযানে আড়াইশরও বেশি সন্দেহভাজন মাদক বিক্রেতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম উদ্দিন, শামীম হায়দার পাটোয়ারি, রওশন আরা মান্নান, নুরে হাসনা লিলি চৌধুরী, আক্কাছ আলী সরদার, নুরুল ইসলাম মিলন, বিরোধীদলীয় চিফ ‍হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর প্রমুখ আইনটিকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করলেও যেহেতু মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে, সেহেতু এটি পাস না করে জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন।

শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, এটি একটি নিষ্ঠুর আইন। অপরাধগুলোর সার্বিক বিচারে ভয়াবহ আইন। এতে বলা আছে ২৫ গ্রাম মাদক পেলে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া যাবে। আবার শাস্তি হিসেবে কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে। অনূর্ধ্ব শব্দটিও নেই। ফলে বিচারককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

নানা সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে পকেটে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর যে অভিযোগ উঠে সেটা নিয়েও কথা বলেন শামীম হায়দার। বলেন, ‘এটা নিষ্ঠুর আইন। এই আইনটা বলব হারিডলি পাস না করতে।’

পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব আপত্তি নাকচ করলে সেগুলো কণ্ঠভোটে দেন স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী আর সেগুলো নাকচ হয়।

এরপর শামীম হায়দার পাটোয়ারি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তিনি সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড শব্দটি বাদ দিয়ে ‘অনূর্ধ্ব যাবজ্জীবন’ শব্দটি বসানোর প্রস্তাব করেন। বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডবিরোধী সদনে বাংলাদেশ সই করেনি। কিন্তু এটা যত সম্ভব কম হতে পারে।’

শামীম হায়দার আবার বলেন, ‘২৫ গ্রামের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, এটা একটা নিষ্ঠুর আইন। বলা আছে ২৫ গ্রাম পাওয়া গেলেও যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু যদি বাহকের বয়স কম হয়, সে যদি অভাবের কারণে বা অন্য কোনো কারণে এটা বহন করেন, তারপরেও জজ সাহেবকে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।’

‘অনেক কেরিয়ার (বাহক) নিজেও জানে না সে হিরোইন ক্যারি (বহন) করছে। এই আইন অনুযায়ী সে ধরা পড়লে তার যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড হবে। এটা একটা অমানবিক হবে। ১৯৯০ সালের আইনে মৃত্যুদণ্ড ছিল ২০১৮ সালেও মৃত্যুদণ্ড থাকবে, এটা হতে পারে না। তাহলে এই ২৮ বছরে দেশ আগাল না পেছাল?’

পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলেন, ‘মাদক একটি ভয়াবহ সমস্যা। আমাদের সমস্ত স্বপ্ন খানখান হয়ে যাবে, আমরা পথ হারিয়ে ফেলবে যদি মাদককে আমরা প্রতিহত না করতে পারি।’

মৃত্যুদণ্ডের সাজা অতিরিক্ত হয়ে গেছে বলে সংসদে উঠা আপত্তির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এমন আমি মনে করি এটা ১৯৯০ সালেও কার্যকর ছিল। এখানে যারা জজ সাহেব তারা তাদের ‘ই’ পাওয়ার অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন কাকে কী শাস্তি দেবেন। ১৯৯০ থেকে খুব বেশি মৃত্যুদণ্ডের আসামি দেখিনি।’

‘বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসায়ী, পৃষ্ঠপোষক, অর্থ লগ্নীকারী, মদদদাতাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে এসেছি। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যদি নিশ্চিত করতে না পারি, আমরা পথ হারিয়ে ফেলব। ২০২১ বলেন আর ২০৪১ বলেন, আমরা কোথাও যেতে পারব না যদি মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি।’

মানবাধিকার কর্মীর আপত্তি

মানবাধিকার কর্মী নুর খানও এই বিলে সাজাকে মাত্রাতিরিক্ত বলেছেন। তার আশঙ্কা এই আইনে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হবে। এতে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা আরও বাড়বে।

নুর খান বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে তো দীর্ঘদিন ধরেই পকেটে মাদক নিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ আছে। এই আইনের ফলে এই প্রবণতা বাড়বে আর যেহেতু যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকছে, সে জন্য ঘুষের রেটও বেড়ে যাবে।’

আইনে যা বলা আছে

বিলে মাদকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি অভ্যাসবশে মাদকদ্রব্য গ্রহণ বা সেবনকারী ব্যক্তি।

মাদকের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, স্থানান্তর, আমদানি, রপ্তানি, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর, অর্পণ, গ্রহণ, প্রেরণ, লেনদেন, নিলামকরণ, ধারণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, সেবন, প্রয়োগ, ব্যবহারকে এ আইনে অপরাধ গণ্য করা হবে।

আইনে সিসার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের ভেষজ নির্যাস সহযোগে দশমিক ২ শতাংশের ঊর্ধ্বে নিকোটিন এবং এসএস ক্যানেল মিশ্রিত উপাদান।

প্রস্তাবিত আইনের ৯ ধারায় বলা আছে, অ্যালকোহল ছাড়া অন্যান্য মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার হয় এমন কোনও দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, বহন, পরিবহন বা আমদানি–রফতানি, সরবরাহ, বিপণন, গুদামজাত, সেবন বা ব্যবহার, অর্থ বিনিয়োগ বা পৃষ্ঠপোষকতা করা যাবে না।

বিলের ৩৬ ধারায় বলা আছে, কোনও ব্যক্তি আইনের এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বিলের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, অনুমোদন ছাড়া কোনও ব্যক্তি অ্যালকোহল পান করতে পারবেন না। চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন বা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনও মুসলমানকে অ্যালকোহল পানের পারমিট দেওয়া যাবে না।

তবে মুচি, মেথর, ডোম, চা শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর তাড়ি ও পঁচুই এবং পার্বত্য জেলা বা অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে তৈরি করা মদ পান করার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

২৪ ধারায় বলা আছে, তদন্ত কর্মকর্তার যদি এই মর্মে সন্দেহ হয় যে, কোনও ব্যক্তি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মাদকদ্রব্য লুকিয়ে রেখেছেন, তাহলে ওই কর্মকর্তা সন্দেহজনক ব্যক্তির শরীরে এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাম, অ্যান্ডোসকপি এবং রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

৩৩ ধারায় বলা আছে, ‘কোনও ব্যক্তি কোনও মাদকদ্রব্যের  সঙ্গে জড়িত থেকে অবৈধ অর্থ ও সম্পদ  সংগ্রহে লিপ্ত রয়েছেন; মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার এমন সন্দেহ হলে তার ব্যাংক হিসাব বা আয়কর পরীক্ষার প্রয়োজনে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

বিলটি সংসদে উত্থাপনের সময়  উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কিত বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইয়াবার আগ্রাসন ভয়াবহরূপে বেড়েছে। কর্মক্ষম যুব সমাজের বড় একটি অংশ ইয়াবা নামক মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। ইয়াবা ব্যবসার জন্য শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন।

মাদকাসক্ত কি না শনাক্তে ডোপ টেস্ট 

খসড়া আইনে কেউ মাদকাসক্ত কি না, তা যাচাইয়ের জন্য ডোপ টেস্টের বিধান রাখার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ মাদক ছাড়া ধরা পড়লেও শাস্তির সুযোগ থাকছে এই আইনে।

কেউ পরীক্ষায় পজেটিভ প্রমাণ হলে সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের কথা বলা আছে।

০.৫ শতাংশ অ্যালকোহল থাকলে বিয়ার

খসড়া আইনে কোনো পানীয়তে ০.৫ শতাংশ অ্যালকোহল থাকলেই সেটিকে বিয়ার হিসেবে গণ্য করার কথা বলা আছে। এগুলো বিক্রি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।

(আল-আমিন এম তাওহীদ, ২৭অক্টোবর-২০১৮ইং)

SHARE