খুলনা সিটি নির্বাচনে নৌকা বিজয়,

পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে যত ভোটে হেরেছিলেন এবার এর চেয়ে বেশি ভোটে খুলনার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক। প্রায় ৬৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে পরাজিত করেছেন।

নৌকা প্রতীক নিয়ে তালুকদার আবদুল খালেক পেয়েছেন এক লাখ ৭৬ হাজার ৯০২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু ধানের শীষ নিয়ে পেয়েছেন এক লাখ আট হাজার ৯৬৫ ভোট।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের ভিত্তিতে খালেককে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৮৬টি কেন্দ্রের ফল পাওয়া গেছে। জাল ভোটের অভিযোগে তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।

বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত খুলনা সিটি নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনের ফলাফল জানতে রাত আটটার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। এ সময় তার সমর্থকরা বাইরে উল্লাস করতে থাকেন। খালেকের বিজয়ের খবর শুনে নগরীজুড়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনে খুলনায় বেশ বড় ব্যবধানে জিতেন তালুকদার আবদুল খালেক। পাঁচ বছরে তিনি চোখে পড়ার মতো উন্নয়নও করেন। এ নিয়ে নগরবাসী খুব একটা অসন্তুষ্ট ছিল, এমনটাও নয়। তারপরেও নানা কারণে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির কাছে প্রায় ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তালুকদার খালেক।

খুলনা সিটি নির্বাচনে হারলেও বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মংলা) আসন থেকে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্য তালুকদার আবদুল খালেক। এবার তিনি মেয়র নির্বাচনে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে সংসদ সদস্য পদ ছাড়তে হয়। অবশেষে দলীয় সিদ্ধান্তে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে তিনি মেয়র প্রার্থী হন।

এই নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সবধরনের আয়োজন সম্পন্ন করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বিঘ্নে ভোট উৎসব শেষ করতে প্রশাসনের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল ইসির। তবুও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। জাল ভোট দেয়ার অভিযোগে তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্রে জালভোটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি একশ কেন্দ্রে পুনরায় ভোট দাবি করেছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপিও ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ এনেছে এবং ‘কারচুপি’ হওয়া কেন্দ্রগুলোতে পুনরায় ভোট দাবি করেছে।

তবে তালুকদার আবদুল খালেক দাবি করেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটের শুরুতেই তিনি জানিয়েছিলেন, খুলনাবাসী যে রায় দেবেন তা তিনি মেনে নেবেন।

এদিকে নির্বাচন কমিশনও এই ভোটে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন এই ভোটকে ‘চমৎকার’ ও ‘সুন্দর’ অভিহিত করেছেন। বিএনপির অভিযোগ পেয়ে তারা যাচাই-বাছাই করেছেন বলেও জানান ইসি সচিব। যেখানে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন সেখানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন অংশ নিলেও মূলত নৌকা আর ধানের শীষের মধ্যে লড়াই হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও এই ভোটকে কেন্দ্র করে সারাদেশেই আগ্রহ তৈরি হয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় এই নির্বাচন আলাদা গুরুত্ব বহন করছে।

নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বাকি তিনজন হলেন ইসলামী আন্দোলনের মুজ্জাম্মিল হক (হাত পাখা), সিপিবির মিজানুর রহমান বাবু (কাস্তে) ও জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান (লাঙ্গল)।

পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে সকাল থেকেই প্রতিটি কেন্দ্রে ভিড় করতে থাকে ভোটাররা। প্রতিটি লাইনে ছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি। পুরুষদের পাশাপাশি নারী ভোটাররাও সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। এছাড়া নতুন ভোটারদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।

ভোট শুরুর পরই সকালে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন তালুকদার আবদুল খালেক। এ সময় তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বলেন, খুলনাবাসী উন্নয়নের পক্ষে ভোট দেবে। ভোটাররা যেন তাদের ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে নেতাকর্মীদের ব্রিফিং দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

বিএনপির প্রার্থী মঞ্জু ভোট দেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের রহিমা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এ সময় তিনি ৩০টি কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করেন। বলেন, সরকারদলীয় সমর্থকদের কারণে প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোটাররা শঙ্কায় রয়েছে। ভোট ডাকাতি হলে ফলাফল মেনে নেবেন না বলেও জানান তিনি।

খুলনা সিটিতে এবার মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৬ জন আর নারী ভোটার দুই লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন। নির্বাচনে ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ড, ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মোট ভোটকেন্দ্র ২৮৯টি। মোট ভোটকক্ষ এক হাজার ৫৬১টি। এর মধ্যে দুটি কেন্দ্রের ১০টি ভোটকক্ষে ভোট নেয়া হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে।

নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন ছাড়াও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৫ জনসহ মোট ১৯১ জন প্রার্থী লড়াই করছেন।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুলনায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৩ মে থেকে খুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন শুরু হয়। তারা থাকবে ১৬ মে পর্যন্ত। পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার-ভিডিপি, ব্যাটালিয়ন আনসারসহ নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা ভোটের নিরাপত্তায় কাজ করবেন।

প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে ২২ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২৪ জন করে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়। নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রতি ওয়ার্ডে পুলিশের মোবাইল ফোর্স এবং প্রতি তিন ওয়ার্ডের জন্য একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করা হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে র‌্যাবের একটি করে দল টহল দেয়। মোতায়েন আছে ১৬ প্লাটুন বিজিবি।

৬০ জন নির্বাহী এবং ১০ জন বিচারিক হাকিম নিয়োগ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হচ্ছে, যেখান থেকে সার্বক্ষণিক নির্বাচনী এলাকার সাথে যোগাযোগ এবং নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

(আল-আমিন এম তাওহীদ, ১৫মে-২০১৮ইং)

SHARE