সড়কে শিক্ষকদের জুমার নামাজ দাবি পূরণ না হলে ঘরে ফিরবো না

বিশেষ প্রতিনিধিঃ
সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ছাড়া আর কারও ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত এবারের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, দাবি আদায় ছাড়া এবার আর ঘরে ফিরবেন না তারা।

এদিকে, দুই দিনের আন্দোলনে বেশ কয়েকজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এরমধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিসিইউতে নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় গতকাল দুপুরে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সোহরাব হোসাইনের বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সরজমিন গতকাল প্রেস ক্লাসের সামনে দেখা যায়, এমপিওভুক্তির দাবিতে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের টানা দ্বিতীয় দিনের মতো অবস্থান করছেন। দুপুরে সড়কেই তারা জুমার নামাজ আদায় করেন। শিক্ষকরা জানান, গত বছর প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবি মেনে নিয়েছেন বলে আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের বৈঠক করে আমাদের কর্মসূচি স্থগিত করি। কিন্তু ৮ মাস পার হলেও এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ কারও ওপর আমাদের আস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ছাড়া রাজপথ ছাড়বো না। শিক্ষক প্রতিনিধিরা জানান, অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়ায় শৈলেন চন্দ্র মজুমদার নামে ৫০ বছর বয়সি একজন শিক্ষককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের শাহবাগ জোনের পরিদর্শক (পেট্রোল) আবুল বাশার বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শিক্ষকরা রাস্তায় অবস্থান করছেন। ফলে প্রেস ক্লাবের একটি অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। পূর্বপাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে।
আন্দোলনরত শিক্ষক কুড়িগ্রাম রৌমারি উপজেলার হুমায়ুন কবির বলেন, রৌমারি উপজেলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দুর্গম চরাঞ্চলের মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। ২০০২ সাল থেকে সরকারি কোনো অনুদান ছাড়াই ৯ জন শিক্ষক আর ৭ কর্মচারী দিয়ে নারীশিক্ষা প্রসারে কাজ করছি। সব যোগ্যতা থাকার পরও এমপিও পাচ্ছি না। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি এখন আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আন্দোলরত কয়েকজন মহিলা শিক্ষকদের সঙ্গে তার শিশুদের নিয়ে আসতে দেখা গেছে। তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড লেখা ছিল। ‘আমার মায়ের বেতন চাই’ সম্বলিত একটি প্ল্যাকার্ডে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া বলেন, ‘আম্মা শুধু পড়ায়, কিন্তু বেতন পায় না। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার আবদার- তার মা যেন দ্রুত বেতন পায়।’ ওই শিশুর মা নাসরিন জাহান বলেন, এর আগে আন্দোলনের সময় সুরাইয়া আসতে চেয়েছিল। আমি আনিনি। এবার তাকে রেখে আর আসতে পারলাম না। রাজবাড়ী পাংশার সেনগ্রাম মহিলা দাখিল মাদরাসার শিক্ষিকা মোমেনা খাতুন বলেন, ২০০৩ সালে তাদের প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। বর্তমানে সাড়ে তিনশ শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের। গত বছর ২০ জন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। প্রতি বছরই আমাদের শতভাগ পাস করে। কিন্তু মাদরাসা থেকেও কোনো টাকা আমরা পাই না। এই অবস্থায় আমরা ১৭ জন শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমাদের সংসার এভাবে আর চলে না।

আন্দোলনরত শিক্ষক জানান, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে আট মাস আগে প্রেস ক্লাবের সামনে থেকেই ১৭ দিনের অনশন ভেঙে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আশ্বাস পূরণ না হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার থেকে আবার রাস্তায় অবস্থান নিয়েছি। শিক্ষকদের হাতে ‘আমার মায়ের বেতন চাই, চাকরি আছে বেতন নাই’, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে কিছু বলতে চাই’, ‘উই ওয়ান্ট এমপিও’- এ রকম নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ছিল। শিক্ষক প্রতিনিধিরা বলছেন, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ঢাকায় এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। রাস্তার ওপরই তারা জুমার নামাজ পড়েছেন।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার মানবজমিনকে বলেন, এবার প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি আশ্বাস ছাড়া রাজপথ ছাড়বো না। অনেক আশ্বাস পেয়েছি। কিন্তু দাবির কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এবার কারও আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই না।

জানা গেছে, গতকাল শিক্ষাসচিব ফোন করে তাদের অফিসার্স ক্লাবে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের ১৪ জনকে নিয়ে তিনি সচিবের সঙ্গে দেখা করেন। এ ব্যাপারে গোলাম মাহমুদুন্নবী বলেন, সচিব মহোদয় বলেছেন, আপনারা সরকারের উপর আস্থা রেখে চলে যান। আমরা সচিবকে বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। তখন উনি (সচিব) বলেছেন, আপনারা চলে যান আমরা চেষ্টা করব। উনার কথার আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি, চলে এসেছি। ডলার জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সাক্ষাতের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন সচিব সোহরাব। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কেউ এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করেন নি জানিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করবেন না।

সাধারণ শিক্ষকরা জানান, গত বছর ১১ই জুলাই জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী ও ড. সারওয়ার আলী অনশনস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আশ্বাসের কথা শিক্ষকদের সামনে তুলে ধরেন এবং পানি পান করিয়ে শিক্ষকদের অনশন ভাঙান। শিক্ষকরা বলেন, আমরা সন্তুষ্ট হয়েই বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম, ক্লাস নিতে শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে নির্বাচন গেল, কিন্তু অজানা কারণে আজও আমাদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলো না। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করলো না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের মূল বেতন সরকার দিয়ে থাকে। নিজ নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে সংসদ সদস্যদেরও সুপারিশ থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি শর্ত দিয়ে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হবে বলে বাজেটের আগে জানিয়েছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু বাজেটে এমপিও নিয়ে কোনো ঘোষণা না থাকায় আমরণ অনশনে বসেন নন-এমপিও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। তাদের আন্দোলনের মধ্যে গতবছর ৪ঠা জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিওভুক্তির কার্যক্রম দ্রুত শুরুর কথা সংসদে জানান। সেদিন তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সারা দেশে এক হাজার ৬২৪টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। অবশিষ্ট নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত করতে ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা ২০১৮’ জারি করা হয়েছে। ওই নীতিমালা অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে দুটি কমিটি করা হয়েছে।

SHARE