চলে গেলেন ভোলার অসহায় রুগীদের উপকারের ফেরীওয়ালা

মীর মোহাম্মদ জসিম :
বয়স মাত্র ২৫। মানুষের সেবা এবং উপকারই তার নেশা। মানুষের জন্য কিছু একটা করার মধ্যেই যিনি পেতেন পরমানন্দ। আর তাইতো দলমত নির্বিশেষে সবার সমস্যায় ছুটে যেতেন আপন গতিতে।

সময় যাই হোক রাত ১২টা, ১টা কিংবা রাত ৪টা। কারো বিপদ শুনলেই যার উপস্থিতি ছিলো শতভাগ। কেউ জেলে গেলে তার বাড়িতে বাজার থেকে শুরু করে জেলখানায় একটু আরাম করে থাকার ব্যবস্থা করতেন সাধ্যমতো। কোন গরীব ছাত্রের ফরম পূরণের ব্যবস্থাও করতেন সাধ্যমতো। এতো সবকিছুর মাঝেও বৃদ্ধ বাবার প্রতি ছিলেন অতি দূর্বল।

বাবার ভালোবাসাও ছিলো ইয়াকুব-ইউসুফের মতো। ছোট বেলায় মাকে হারান।বাবার আদর স্নেহে মানুষ হয়ে ওঠেন।

অল্প বয়সেই বিয়ে করেন নাঈম। তবে মানুষের মাঝে নিজেকে বিলীন করতে গিয়ে নিজের স্ত্রী-সন্তানকে বঞ্চিত করেছেন হরহামেশাই। অন্যের মুখে হাসি ফেটাতে গিয়ে টাকার অপ্রতুলতায় নিজের ছোট ফুটফুটে সন্তানের জন্য অনেক ঈদেই নতুন জামা কিনে দিতে পারেন নি। নিজের জন্যতো কেনার প্রশ্নই আসে না।

প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন মুমূর্ষু রােগীর জন্য রক্তের ব্যবস্থা করে দিতেন। সেটি হোক এলাকা কিংবা বরিশাল অথবা ঢাকা।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে নিজ বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ভোলা সদরে রোজা রেখে নিজের টাকা খরচ করে এক মুমূর্ষু রােগীকে রক্ত ডোনেট করলেন।

সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলতেন। তার মন কাড়ানো হাসি সবাইকে মুহুর্তের মধ্যে তার প্রতি দূর্বল করে তুলতো।। হাসির মধ্যে ছিল অন্যরকম যাদু।।

জীবন যুদ্ধে পরিশ্রমি এ মানুষটি কখনোই কারো করুনার মুখাপেক্ষী ছিলেন না। নিজে কিছু করার চেষ্টা করতেন সর্বদা। তবে তার সরলতার সুযোগ নিয়েছেন অনেকেই।

এ মানুষটি আমার ছোট ভাই নাঈম শরীফ।
রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সম্পর্ক ছিলো বর্ননাতীত।। অনেক তদবিরের জন্যই আমাকে জ্বালাতেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন কারো কোন ক্ষতি করার সাধনে নাঈম শরীফের কাছ থেকে কোন ফোন পাইনি।। আসলে তার ব্রতই ছিলো মানবসেবা।। মানুষের ক্ষতি তার ধারণার বাইরেই ছিলো।

বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বসা। হঠাৎ নাঈমের ফোন। মূমুর্ষু রোগীকে রক্ত দেয়ায় ধন্যবাদ জানালাম। রক্ত দিতে পেরে নাঈমও খুব খুশি।
রাত একটা আমি ঘুমাচ্ছিলাম। অনেকের ফোন। কারো ফোনই রিসিভ করিনি। ১টা ১৫ মিনিটে নয়নকে কল ব্যাক করলাম। ওপার থেকে হাউমাউ কান্নার শব্দ। নয়ন বললো ভাই নাঈম ভাই মারা গেছে। এরপর সারারাত বহু ছোটভাই’র সাথে কথা হয়। যারা আমার কাছে নাঈমের মতোই। সবার ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই শুধু হাউমাউ করে কান্নার শব্দ।

কোন একজন লোকের মৃত্যুতে এতো লোক কাঁদতে আমি কখনোই দেখিনি।। এ কান্না ছিলো সত্যিকার অর্থেই অন্তরের কান্না।

খুব কম লোকের মৃত্যুতে আমি নিজে কেঁদেছি। কষ্ট পাই সকলের মৃত্যুতেই। কিন্তু নাঈমের বেলায় এতো কষ্ট পেয়েছি যা ব্যক্ত করার মতো নয়।
অর্থাৎ সবাইকে কাঁদিয়ে নাফেরার দেশে চলে গেলেন ভোলার অসহায় রুগীদের এই উপকারের ফেরীওয়ালা।

নাঈমকে তো আর পাবো না।। তবে কথা দিচ্ছি নাঈমের পরিবারের পাশে আমরা সবসময়ই থাকবো।

আমাদের উচিত সবাই নাঈমের মতো মানুষের তরে নিজেকে বিলীন করে দেয়া। নাঈম সেটাই আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। এটাই নাঈমের আদর্শ। এ আদর্শই আমাদের সকলের হওয়া উচিত। এ কারণেই নাঈম আমাদের মাঝে হাজার বছর বেঁচে থাকবে।

আল্লাহ নিশ্চয়ই নাঈমকে তার কাজের প্রতিদান দিবেন। আমরাও দোয়া করি আল্লাহ যাতে তাকে জান্নাতের উচ্চস্থান দান করেন।

সত্যিকার অর্থে সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। যারা মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে নিজের আরাম আয়েশ বিসর্জন দেয় তারাইতো প্রকৃত মানুষ।

# লেখক ঢাবি সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি
# লেখাটি Md HA Sharif ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত

SHARE