আবুল কারাম আজাদঃ
মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি)-তে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা জানে না ‘এসএসসি’ মানে কি। ‘জিপিএ’ মানে কি তাও জানে না। ২০১৬ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সাক্ষাতকার নিয়ে মাছরাঙা টেলিভিশনে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে সেসময় উঠে এসেছিল শিক্ষার এমন দুর্দশার চিত্র।
প্রতিবেদনে সাংবাদিক জিপিএ-৫ প্রাপ্ত একজন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করেন, আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি- এই বাক্যের ইংরেজি কি? জবাবে এক শিক্ষার্থী বলে- ‘আই এম জিপিএ-৫’। অপারেশন সার্চলাইট কি, এই প্রশ্নের জবাবে জিপিএ-৫ পাওয়া এক ছাত্রী বলে- ‘অপারেশন করার সময় যে লাইট জ্বালায় সেটাই অপারেশন সার্চলাইট।’
মাছরাঙা টেলিভিশনের সেই প্রতিবেদনটি ভাইরাল হয়েছিল ফেসবুকে। প্রতিবেদনটির ভিডিওচিত্র ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে কেউ কেউ হাসাহাসি করছেন। আবার অনেকেই পাশের হারের বাম্পার ফলনের আড়ালে বাংলাদেশের শিক্ষার করুণ দিকটি তুলে ধরে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমন প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সংবাদের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
বছর বছর পাসের হার বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মান অর্জিত হচ্ছেনা। এখন আর রেজাল্ট দিয়ে শিক্ষার্থীর মান বোঝার উপায় নেই। জে এস সি, এসএসসি ও এইসএসসিতে এ প্লাস পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেনা অনেক শিক্ষার্থীরা। মেধার ভিত্তিতে ফলাফল হলে সার্বিক ফলাফল এক বছরের তুলনায় অন্যবছরের ফলাফল ভাল কিংবা মন্দ হতো। কিন্তু সেটা না হয়ে ঘটছে তার উল্টো চিত্র। প্রতি বছরই যেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। জোড়াতালি দিয়ে পাস করানোর নির্দেশনা কখনোই কল্যাণ হতে পারে না। পেছনে অশুভ শক্তির হাত কে দুর্বল করে দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। ভেবে দেখার বিষয় সুন্দর ফলাফলের সুনাম আসলে কার শিক্ষার্থীর নাকি সরকারের নাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ?
প্রতি বছর এসএসসি ও সমমানের এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর লক্ষ করা যায়, শিক্ষায় আগ্রহী ব্যক্তিরা সাধারণভাবে আগের বছরের ফলাফলের সঙ্গে চলতি বছরের ফলাফল তুলনা করে এ বিষয়ে মন্তব্য করে থাকেন। এ ধরনের বিশ্লেষণের চেয়ে জরুরি হল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা বিশ্লেষণ করা। আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান না বাড়লে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়বে।
লক্ষ করা যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অভিভাবক সবসময় ব্যস্ত থাকেন কী করে তাদের সন্তান জিপিএ-৫ পাবে। অনেক অভিভাবকের ধারণা, তার সন্তানের জিপিএ-৫ না পাওয়ার অর্থই হল ওই শিক্ষার্থী জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে না। এমন ধারণা যে একেবারেই ভিত্তিহীন তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে।
শিক্ষার্থীদের ফলাফল ভালো হলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেশী আনন্দিত হওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হতে দেখা যায়নি। যে কোন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর যে সব আর্টিক্যাল ছাপা হয়েছে তার অধিকাংশের লেখক স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেসব আর্টিক্যালে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকের উল্লেখ থাকলেও নেতিবাচক দিকের কথাই বেশী তুলে ধরা হয়েছে। তার কারণ হলো, শিক্ষক শ্রেণী যেহেতু সমাজের দর্পণ, সেকারণে শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের আকাঙ্খা হলো শিক্ষার গুণমান বজায় রেখে সুন্দর ফলাফল অর্জন। শিক্ষার্থীদের মাঝে যখন গুণগত মানের অনুপস্থিতি দেখা যায় তখন স্বভাবতই শিক্ষকরা অভিভাবকের ভূমিকায় থেকে খুশি হতে পারেন না। আর শিক্ষার্থীর মান সম্পর্কে শিক্ষকের চেয়ে বেশী কেউ জানার কথা নয়।
শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যে লেখা ছাপা হয়েছে তার কয়েকটি শিরোনাম দেখলেই এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ফলাফল নয়, চাই মেধার মূল্যায়ন, প্রশ্নফাঁস ও উদারহস্তে খাতা মূল্যায়ন, সাফল্যের সাতকাহন, পাসের হার, জিপিএ’তে রেকর্ড, আশানুরূপ হলেও কথা অনেক, ভাল ফল শিক্ষার মানদণ্ড- নয় , সব সূচক ইতিবাচক হলেও মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন , বিস্ময়কর ফল , মান নিয়ে বড় প্রশ্ন , রেকর্ড ভাঙ্গলেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছেনা ! । এসব শিরোনামে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সুতারং জিপিএ-৫ ও পাশের হার বৃদ্ধি হলেই গুণগত মান অর্জিত হয়েছে সে কথা বলা হয়তো সঠিক হবেনা । যে সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর পাশের সংখ্যা খুবই নগণ্য বা বিগত বছরগুলোতে পাশের হার শূন্য ছিল, সে সব প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে এমন আইনের কারণে তাকে পাশ করানোর যত পন্থা আছে কতিপয় প্রতিষ্ঠান সেটাই অবলম্বন করে থাকে। এতে করে পাশের হার বাড়লেও বাড়ছেনা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর গুণগত মান। বেশী বেশী ভাল রেজাল্ট করেও জাতী কেন দিন দিন পঙ্গু হচ্ছে এ প্রশ্ন সবার। শিক্ষা খাতে সরকারের নয়া পদক্ষেপের কারণে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার্থীরা তেমন উন্নতি করতে পারছেনা। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ায় ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকই শিক্ষার্থীর মাঝে বিদ্যমান। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করাই যুক্তিযুক্ত। এসব পরীক্ষা দিয়ে যা অর্জন হলো তা তো সর্বদা বর্জনীয়। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা যে অনিয়ম স্ব চোক্ষে দেখেছে তাতে মনে হচ্ছে তারা আর কখনোই পড়ার টেবিলে বসবে না। নকল কি তা শিক্ষার্থীর জানা ছিল না। অথচ সেই শিক্ষার্থীকে নকলের ব্যবহারিক ক্লাশ করতে হয়েছে। এটা যদি বন্ধ না করা হয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষায় পঙ্গত্ব বরণ করতে বাধ্য।
শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। মেরুদণ্ডের কাজ হলো শরীরের ওজনকে বহন করা। শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে বিতর্কিত, যতটা অসুস্থ তাতে গোটা জাতীর ভার বহন করার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষা নামক মেরুদণ্ডের সুচিকিৎসা। প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদের কে ধরার উদ্যোগ না নিয়ে প্রশ্নকে সাজেশন বলে সাফাই গাওয়ার অসত্য বক্তব্যই প্রমাণ করে জাতি অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতা বর্জিত শিক্ষার ফলে দিন-দিন শিক্ষার মান কমছে। মানুষ হওয়ার প্রত্যয় নেই। কোন পেশায় গেলে বেশী টাকা আয় করা যাবে এটাই যেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। শিক্ষার মান যেন শিক্ষার্থীর কাছে নেই, জিপিএ সিস্টেমের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। গুণগত মান কেবল সদিচ্ছা, পরিশ্রম ও আন্তরিকতার উপর নির্ভর করেনা। এর সঙ্গে শিক্ষার দর্শন ও জাতীয় লক্ষ্যাদর্শের মতো বৃহত্তর বিবেচনার বিষয় যেমন থাকে তেমনি থাকে শিশু মনস্তত্ত্ব , শিক্ষার্থীর দক্ষতা, শিক্ষার পদ্ধতি-কৌশল ,পাঠ্যবই প্রণয়ন-কৌশল, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি, শ্রেণিকক্ষে পাঠ উপস্থাপন পদ্ধতি ইত্যাদি বাহ্যত টেকনিক্যাল বিষয়সমূহের উপস্থিতি প্রয়োজন। ভালো ফলাফল সর্বদাই আনন্দের। তবে অযোগ্য শিক্ষার্থীর কাছে ভালো ফলাফল এক ধরণের বোঝা।
শিক্ষকদের প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যেতে হবে। পাঠদানের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার পরিবর্তে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা নয় সুশিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অভিভাবকদের অতিমাত্রায় সচেতন হতে হবে। তবেই শিক্ষার যথার্থতা নিশ্চিত হবে।
লেখকঃ
আবুল কালাম আজাদ
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংগঠক