বিশেষ প্রতিনিধিঃ ভোলার মুক্তিযুদ্ধ, রাজনিতি ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখাটি লিখেছেন একজন প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধা, কবি, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সচেতন সমাজ সেবক মাহবুবুল আলম রহমান নিরব। যাকে ভোলার মানুষ নিরব মোল্লা নামেই চিনে। তার এই লেখাটি ভোলা নিউজের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো….
” হামিদুল হক বাহালুল মোল্লার জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়পত্র সংগ্রহ করেছেন।
হামিদুল হক বাহলুল মোল্লার মনোনয়ন চাওয়া কি অপরাধ? দলে যোগ্যতা সম্পন্ন যেকেউ তা চাইতে পারেন।
কথাহলো ঐ পদের জন্য তিনি উপযুক্ত কিনা?
বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই আমাদের দেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য একটি বড় বিষয় হয়ে কাজ করেছে। পরিবার কেন্দ্রিক প্রভাব নিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ভোলাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি পরিবার কে ঘিরে ভোলার রাজনৈতিক অঙ্গন আবর্তিত হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ভোলার মোল্লা পরিবার।
এই পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি আর ঐতিহ্য, ভোলায় দীর্ঘদিনের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একদা এই পরিবার ঘিরেই আওয়ামী রাজনীতি আবর্তিত হতো। আওয়ামী রাজনীতির শুরু থেকেই এই পরিবার এর সাথে জড়িত।এ ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য বিশিষ্ট শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ নেতা ভোলা-১ আসনের উপনির্বাচনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত জাতীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন শহীদ ওবায়দুল হক বাবুল মোল্লা। যে কারণে ঘাতকের বুলেট বাবুলের বক্ষ বিদীর্ণ করে দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পারিবারিক ঐতিহ্য।উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাবুলের জনসমর্থন,জনপ্রিয়তা ছিল প্রতিপক্ষ রাজনীতিকের আতঙ্কের অন্যতম কারণ ।মুক্তিযোদ্ধা বাবুল খুব অল্প দিনেই অল্প সময়ে রাজনীতির লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হতেন, যে কারণে লক্ষ্যে পৌঁছার আগেই তাকে পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে সরিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন মাটির ঘরে স্থান করে দেওয়া হয়েছে। বাবুলের মরদেহ ভোলার জনগোষ্ঠীর চোখের আড়াল হলেও বাবুল ভোলার ১৮ লাখ মানুষের কাছে অতি আপনজন অতি ভালোবাসার, অতি আদরের এক মানুষ। শুধু বাবুল একা নন, এই পরিবারে জন্ম লাভকারী গোটা মোল্লা পরিবার আজ ভোলাবাসীর কাছে শ্রদ্ধার সাথে বিদিত একটি পরিবার। রাজনীতির কলুষিত দূর্নীতি প্রতিহিংসা এদের স্পর্শ করেনি।সোলায়মান মোল্লাহ এই পরিবারের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তার অন্য ভাইরাও রাজনীতিতে অংশ নেয় । সোলায়মান মোল্লা কলকাতা অবস্থানকালে হোসেন শহীদ সরোয়ারদির সাহচার্যে আসেন এবং সেখানে বসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে পরিচিত হন।
পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী মুসলিমলীগের সাথে সম্পৃক্ত হন । ১৯৫৩ সালে ভোলা তখনো জেলা হিসেবে মর্যাদা পায়নি, মাওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সশরীরে উপস্থিত হয়ে সোলায়মান মোল্লাকে সভাপতি করে ভোলা মহাকুমা আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটি গঠন করেন। সূচনা থেকেই ভোলায় আওয়ামিলীগ এবং মোল্লা পরিবারের এই পথচলা এখনো অবিচ্ছেদ্দ।
পরবর্তিতে সোলায়মান মোল্লা ভোলা পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম মুসলিম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন । আইয়ুব খানের সামরিক আইন চলাকালীন সময়েও তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন । তার ছোট ভাই আবু-আল ফারাহ চৌধুরী মোল্লা বাপ্তা ইউনিয়ন এর দীর্ঘ ৩৫ বছর স্বনামধন্য চেয়ারম্যান ছিলেন, তার ছেলে ইয়ানুর রহমান বিপ্লব মোল্লা বর্তমান মেয়াদ সহ চার বার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঊনসত্তরের ১০ জুলাই সোলায়মান মোল্লা চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন । সত্তর সালে বঙ্গবন্ধু ভোলা আসলে প্রথমেই সোলায়মান মোল্লার কবর জিয়ারত করেন । বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল ব্যক্তিগত ও বন্ধু পর্যায়ের। শহীদ ওবায়দুল হক বাবুল মোল্লা তার বড় ছেলে। ভোলা পৌরসভা সোলায়মান মোল্লার নামে একটি সড়কের নামকরণ করেছেন, বাবুল মোল্লার নামে কলেজ ও স্কুল রয়েছে। জনগণ মোল্লাবাড়ির এলাকাকে মোল্লা পট্টি নামে অভিহিত করেন। আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে এই পরিবারের সদস্যদের অবস্থান সুদৃঢ় এবং দীর্ঘদিনের। এই পরিবারের বড় ছেলে মোহাম্মদ ফারুক মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের জি এস,পরবর্তিকালে সরকারি চাকুরিতে যোগদেন , রাষ্ট্রদুত থাকা অবস্থায় বি এন পি আমলে তাকে বাধ্যতামূলেক অবসর দেওয়াহয় আওয়ামী পরিবারভূক্ত বলে।ওবায়দুল হক বাবুল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক ফজলুল হক হলের ভিপি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ভিপি এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি ভোলা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালীন ভোলা মহাকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন।বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের তৃত্বীয় মেয়াদে সভাপতি।সোলায়মান মোল্লার ছেলে ও শহীদ বাবুল মোল্লার ছোট ভাই, হামিদুল হক বাহালুল মোল্লা, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।বর্তমানে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য।এছাড়াও বাহালুল মোল্লা ভোলা পৌরসভার কমিশনার ছিলেন এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি ছিলেন , বর্তমানে বাংলাদেশ সুটিং ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য ও ভোলা জেলা ফুটবল ফেডারেশনর সভাপতি। তৃত্বীয় ভাই শহিদুল হক মুকুল মোল্লা কাপ্তাই ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগের ভোলা জেলা কমিটির নির্বাহী সদস্য। একাধিকবার বিজিএমইএ পরিচালক ও ঢাকাস্হ ভোলা জেলা সমিতির সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। বিপ্লব মোল্লা ছাত্রলীগের ভোলা কলেজ সংসদে ভিপি নির্বাচন করেছিলেন এবং জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। এই পরিবারের অন্যরা সবাই ব্যবসায়িকভাবে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত । ইরফানুর রহমান মিথুন মোল্লা দ্বিতীয় মেয়াদে পৌরসভার কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এদের পরের প্রজন্ম ও একই রাজনীতৈক দলের সাথে সম্পৃক্ত হতে চলেছেন।মাহাবুবুল আলম নীরব মোল্লার আজিজ মেহরাব মোল্লা ইতিমধ্যেই ভোলা জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়ার সহ-সভাপতির দায়িত্বে কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পরিবারটির ছিল অনবদ্য ভূমিকা বাড়ির ছোট বড় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে কম বেশি অবদান রেখেছিলেন ফজলুল কাদের মজনু ও ওবায়দুল হক বাবুল স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র টেলিগ্রাম মারফত পাওয়ার সাথে সাথেই ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচার করেছেন। চৌধুরী মোল্লা এবং জহিরুল ইসলাম মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, আর্থিক ভাবে সাহায্য প্রদান করেছেন। ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা মহাকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকার সাথে একই সঙ্গে ভোলা সদর রোড বরিশাল বিল্ডিং ও মহকুমা প্রশাসকের অফিসের সামনে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন । নীরব ও বাহালুল মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান, সেখানে ট্রেনিং অবস্থায় মুজিব বাহিনী অন্যতম সংগঠক রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল আহমেদের সাথে দেখা হয়, পরে কিছুদিন ক্যালকাটায় মুজিব বাহিনীর সদর দপ্তরে থাকার পরে , খুলনা মুজিব বাহিনীর প্রধান কামরুজ্জামান টুকুর সাথে তারা খুলনায় প্রবেশ করেন। বাবুল মোল্লা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন এবং মুজিব বাহিনীর মহকুমা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ।মুক্তিযুদ্ধের সময় মোল্লাবাড়িতে মহিলাদের জন্য একটি যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। অনেক মহিলা মুক্তিযোদ্ধা এখানে রাইফেল এবং ফাস্ট এইড ট্রেনিং নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো মোল্লাবাড়ি একাধিকবার লুট করে নেয় পাকবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা। মোল্লাদের সবচেয়ে গৌরবের বিষয় হচ্ছে, সাধারণত বড় বড় পরিবার গুলোতে নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকে, মোল্লা পরিবারে তা নেই , একই বাড়িতে অনেক রাজনৈতিক দল থাকে , মোল্লা পরিবারের শুধু একটিই দল, আওয়ামীলীগ। পরিবারের পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সকলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ক্ষমতা ও লোভের রাজনীতির সাথে এই পরিবারের কেউ জড়িয়ে পড়েননি। আদর্ষিক রাজনৈতিক পরিবার হিসেবে সকলের কাছে মোল্লা পরিবার পরিচিত। কোন সন্দেহ নেই যে, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও আওয়ামী আদর্শের উত্তরাধিকারী হয়েই বেঁচে আছে এই পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা । তথাপি আজ অবদি বাবুল হত্যার বিচার অধরাই রয়েগেল, তার হত্যার পর পাঁচ বছর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ছিল,কিন্তু ভোলা সংসদীয় আসনে নির্বাচন হলোনা।মোল্লাদের সবচেয়ে বড় কষ্টের কারন হয়ে বংশ পরম্পরায় এটা থেকে যাবে।দল ক্ষমতায় এলে মোল্লাদের অবমূল্যায়ন করা স্বার্থবুদ্ধি প্রনোদিত লোকদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। দল ক্ষমতা হারালে এরা চোখের পলকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলেযায়।এবং অবৈধ অর্থের বিনিময়ে, সূখে শান্তিতে বসবাস করে ,অথবা দল বদল করে।মোল্লারা যেই তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়।””
ভোলা নিউজ /টিপু সুলতান