।। তাইফুর সরোয়ার।।
শীতের মধ্য রাত। কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে সারা গ্রাম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে এক ঝাঁক বাদুর ডানা ঝাপটে উড়ে যায় দূর আকাশে। জোনাকিদের দল এক গাছ থেকে আরেক গাছে গিয়ে আপন মনে আলো বিলিয়ে অন্ধকার গ্রামকে আলোকিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দু’একটা শিয়াল থেকে থেকে ডেকে উঠে। ঘুমন্ত গ্রামের প্রাণ বলতে ঐ একটি- মনিপুর রেল স্টেশন। মধ্যরাত কী আর ভর দুপুরই কী ট্রেন আসা ও যাওয়ার সময় লোকজনের কোলাহলে স্টেশন যেন রূপ নেয় মাছ বাজারে।
রাত একটা বেজে ত্রিশ মিনিট। রাত বারোটার ট্রেন এখনও আসেনি। তাই স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে এক চাপা উত্তোজনা বিরাজ করছে। হাড়কাঁপা শীতে সবাই গরম জামা কাপড় পরে আছে। স্টেশনের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পরা ভিড়। পান, সিগারেট এবং চায়ের ক্রেতাই বেশি। স্টেশনের প্লাটফর্মে আধশোয়া হয়ে কয়েকজন যাত্রী বসে আছে।
অনেকে আবার দেয়ালে পিঠ হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
আমি আমার ব্যাগটা কোলের ভিতরে রেখে প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে আছি। এ সময় একজন মাঝবয়সী লোক আমার কাছে আসল। তার হাতে চা ভর্তি কাপ। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ভাই
সাহেবের নাম কী?
আমি অনেকটা অস্বস্তি বোধ করলাম। ইতঃস্তত আমার নাম বললাম, সমির, সমির চৌধুরী।
কী করেন?
জি, আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।
তারপর লোকটি তার হাতে রাখা চায়ের অর্ধেকটা
পিরিচে রেখে কাপসহ বাকি অর্ধেকটা আমার দিকে
এগিয়ে দিলেন। আমি প্রথমে নিতে চাইনি। ঈষৎ হেসে না করে দিলাম। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। আমাকে বলল, ভাই সাহেব মনে হয় আমাকে
চিনতে পারেনি। অবশ্য পরিচয় না দিলে চিনবেনই বা কি ভাবে। আমি ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন। ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছি। স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে
থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। তাই আপনার সাথে একটু গল্প করতে এলাম।
এরপর লোকটি তার পকেট থেকে তার পরিচয়পত্র বের করে আমাকে দেখাল। আমি তা এক ঝলক দেখে তাকে সেটি ফিরিয়ে দিলাম। ইন্সপেক্টর সাহেব হয়ত ভেবেছিল আমি তার পরিচয় জানতে পেরে খুব খুশি হব। এমন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিজের খুব নিকটে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করব। কিন্তু আমার নিরুৎসাহিতায় এখন হয়ত বুঝতে পেরেছন যে তার ধারণা অনেকটাই ভুল। লোকটির বারংবার অনুরোধে আমি চা নিলাম। লোকটা আবার বলতে শুরু করল, ভাই ট্রেন আজকে আর আসবে না, আসবে কাল সকালে।
আমি অবাক হলাম। চোখ জোড়া বাঁকা করে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি জানলেন কি করে?
পোস্ট মাস্টারের সাথে আমার কথা হয়েছে। এর আগের ট্রেনটা এক্সিডেন্ট করেছে। লাইন ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত পরের ট্রেন আসতে পারবে না।লাইন ক্লিয়ার হতে হতে ভোর হয়ে যাবে।
লোকটার কথা বার্তা খুব সহজ সরল। তার বক্তব্যে কোন কিছুর আড়াল নেই। এ যুগে এরকম অকপটে মনখোলা লোক খুব সাধারণত দেখা যায় না। লোকটার প্রতি ক্রমেই আমার আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি হতে লাগল।
লোকটি আবার বলল, ভাই আপনার সাথে যদিও আমার অল্প সময়ের স্বল্প পরিচয়, তারপরও আপনাকে আমার বেশ
মনে ধরেছে। খুব কাছের মনে হচ্ছে। আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার কাছে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলব। এ কাহিনী এর আগে আমি কাউকে বলিনি। আপনি এর
মধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আমি বাঁচাল
প্রকৃতির মানুষ। আমার মত বেশি কথা বলা মানুষের কাছে এরকম কাহিনী চেপে রাখা
প্রায় অসম্ভব। কাহিনীটি আমার জীবনের একটা
অধ্যায়ের, একটা পরাজয়ের। এর আগে কারো কাছে বলিনি। কিন্তু আমি আর পারছি না। কাহিনীটি যেন আমার পেটের ভেতর থেকে
ক্রমেই উপড়ে আসতে চায়। তাই আজ তা আপনার কাছে বলে আমার মনকে কিছুটা হলেও
হালকা করব।
লোকটির কথায় ক্রমেই আমার আগ্রহ বাড়ছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, হাড়কাপা এই শীতে সেই রাত এগারোটা থেকে বসে থাকতে থাকতে প্রায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছি।। এমন সময় আপনার সঙ্গ কিছুটা হলেও আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে। প্রতিক্ষার প্রহর সব সময় দীর্ঘ হয়। ট্রেন আসতে এখনও অনেক দেরি। এই সময়টা আমরা গল্প করে কাটাতে পারি। শুরু করুন আপনার সেই স্মরনীয় ঘটনা। লোকটা দম নিলেন। বার কয়েক কাশ দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন। এরপর বলা শুরু করলেন,
(চলবে….)