অনলাইন ডেস্ক: ভোলানিউজ.কম,
বিষয়টা খুবই সামান্য। তিনি একটা সহজ যোগ অঙ্ক মিলাতে পারেননি। আর তাই ক্ষেপে গেছেন। এরকম আসলে হয়। কোনো অনিয়ম করে যদি কেউ হাতে নাতে ধরা খেয়ে যান, অথচ তিনি যদি খুব ক্ষমতাবান হন, তখন এরকম হয়। অযোগ্য অথচ ক্ষমতাবান লোকটি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে আবোল-তাবোল বলেন। আমাদের এই ক্ষমতাবান মোফাজ্জল সাহেবও তাই করেছেন। পুরো ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে একটি যোগ অঙ্ক মিলাতে না পেরে প্রশ্নকর্তা ‘বেয়াদব’ সাংবাদিককে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দিয়েছেন!
সময় টেলিভিশনের সাংবাদিক নাজমুস সালেহীকে শুরুতেই ধন্যবাদ দিতে চাই, কারণ তিনি অত্যন্ত জনগুরুত্বসম্পন্ন একটা বিষয়কে তুলে নিয়ে এসেছেন। বিষয়টা হচ্ছে ঢাকা থেকে কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়া। এই ট্রেনে চেয়ার আসনে ২৫০০ টাকা। টিকিটের গায়েই এটা লেখা আছে। যাত্রীরা সবাই এই টাকা দিয়েই টিকিট কিনছেন। টিকিটের গায়ে ২৫০০ টাকার একটা ব্রেকআপও দেওয়া আছে। সেখানে লেখা ভাড়া ১৬৮০ টাকা, ভ্যাট ২৫২ টাকা, ভ্রমণ কর ৫০০ টাকা। এই তিনটি যোগ করলে হয় ২৪৩২ টাকা। তাহলে বাকি ৬৮ টাকা যাচ্ছে কোন খাতে? এই প্রশ্নটাই করেছেন নাজমুস সালেহী। তিনি যোগ অঙ্কটা মিলাতে পারেননি। ব্রেকআপ যখন দেওয়া আছে, সেক্ষেত্রে ভাড়ার ১৬৮০ টাকা চলে যাচ্ছে রেল বিভাগে, ভ্যাট ও ভ্রমণ কর যাচ্ছে রাজস্ব বিভাগে। প্রশ্ন হচ্ছে বাকি ৬৮ টাকা কোন খাতে, কোন বিভাগে জমা হচ্ছে? যে যাই বলুক, আমার বিবেচনায় এটা একটা মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন।
বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রশ্নটি যখন রেল বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, সচিব মোফাজ্জল হোসেনের কাছে করা হলো, তিনি ক্ষেপে গেলেন। ক্ষিপ্ত যে আসলেই হয়েছিলেন তিনি, সেটা সহজেই বোঝা যায় তার উত্তরগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন, সেগুলো এরকম: এ ব্যাপারে আপনার এত উৎসাহ কেন? এটা আপনার জানার দরকার কী? আপনার কোনো প্রয়োজন আছে? আপনি কি প্যাসেঞ্জার?
এতটুকু বলেই তিনি থামলেন না। সাংবাদিককে পরদিন দুপুর ২টার পর যেতে বললেন, ব্যাখ্যা দেবেন বলে। পরদিন যখন গেলেন, অঙ্কে ফেল মারা সচিব উল্টো সাংবাদিককে অপমান করলেন। বললেনÑ ‘আপনি এখন আত্মহত্যা করেন। একটা স্টেটমেন্ট লিখে যান যে, রেলের লোকেরা আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। এই মর্মে ঘোষণা দিলাম যে, তারা কথা না বলার কারণে আমি আত্মহত্যা করলাম।’
কী ভয়ংকর! একজন সচিব এমন কথা বলতে পারেন? তারও আগে তিনি কীভাবে একজন সাংবাদিককে বলতে পারলেন- ‘আপনার জানার কি দরকার?’ সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন? নিজে ভুক্তভোগী না হলে, সাংবাদিক কি কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন না? আমার তো মনে হয়, এতটুকু পর্যন্ত পড়ে সচেতন পাঠক মাত্রই প্রশ্ন করতে পারেনÑ এই লোক সচিব পদ পর্যন্ত গেলেন কী করে? অবশ্য আমাদের দেশে এরকম হয়। অযোগ্যতা আর জনবিচ্ছিন্নতাই যেন এই দেশের আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। মনে পড়ে বছর দুয়েক আগে, হাওরে যখন বন্যা হলো, মানুষের ফসল, বাড়িঘর ভেসে গেল, তখন ত্রাণ সচিব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে বলেছিলেনÑ হাওরকে দুর্গত এলাকা বলা যায় না। কারণ হিসাবে বলেছিলেনÑ পানিতে ডুবে কোনো গরু-ছাগল মরেনি। পাশে বসে মন্ত্রী মাথা নেড়ে নেড়ে সমর্থন দিয়েছিলেন। ওই মন্ত্রী অবশ্য পরে আর মন্ত্রিত্ব পাননি, এমনকি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পর্যন্ত পাননি। তবে সচিব প্রমোশন পেয়েছেন! দিন কয়েক আগে তার পদোন্নতির খবর দেখলাম। আশা করা যায়, খুব শিগগিরই এই রেল সচিবও প্রমোশন পাবেন।
তবে সাংবাদিক নাজমুস সালেহীকে আমি ধন্যবাদ দেবো, আত্মহত্যার পরামর্শে প্ররোচিত না হয়ে বরং তিনি রেলমন্ত্রী পর্যন্ত গিয়েছেন। মন্ত্রী নতুন। কেবল যে এই মন্ত্রণালয়ে নতুন তাই নয়, মন্ত্রী হিসেবেই নতুন। জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হয়েছেন। তাই তাকেও উত্তর দিতে কিছুটা আড়ষ্ট মনে হলো। তিনি তদন্তের কথা বললেন। তারপর বললেন- যদি সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তাহলে আশা করি সবাই তা মানবেন।
আমি সম্ভাব্য সঠিক ব্যাখ্যাটি নিয়ে ভাবছি। কী হতে পারেÑ এই এলোমেলো যোগের সঠিক ব্যাখ্যা? সবচেয়ে ভালো যে ব্যাখ্যাটি পেয়েছি, সে হচ্ছে- হয়তো বলবেন বাকি টাকাটা সরকারের খাতেই জমা হয়েছে। কিন্তু তখন আবার বেশ কয়েকটা প্রশ্ন ওঠবেÑ কোন খাতে? ‘অদৃশ্য’ বলে কি কোনো খাত আছে সরকারের? থাকতে কি পারে? অথবা সরকার কি পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এভাবে প্রতারণামূলক অর্থ আদায় করতে পারে?
অথবা একটা ব্যাখ্যা এমনও আসতে পারে ভুলে এমন হয়ে গেছে। সেটাই যদি হয়, তাহলে এমন বিরাট একটা ভুলের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে, সাজার আওতায় আনতে হবে। এসব সরকারি কর্মকর্তারা যে বেতন পান, গাড়ি বাড়ি ব্যবহার করেন, সেসব জনগণের কাছ থেকে যায়। জনগণ কেন অযোগ্য, সহজ যোগ অঙ্কে ফেল মারা লোককে দায়িত্বপূর্ণ পদে রাখতে চাইবে?
লেখক: কলামিস্ট ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
(আরজে, ১২ফেব্রু-২০১৯ইং)