লাশ ঘরের চিঠি

মোঃ আশরাফুল আলম-
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে করনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হয়ে মারা যান, এমন একজন ডাক্তারের করুন আর্তনাদ নিয়ে দৌলতখান উপজেলার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা জনাব খবির হোসেন চৌধুরীর লেখা এবং নিজের কন্ঠে আবৃত করা হৃদয় ছুয়ে যাওয়ার মত অসাধরণ একটি কবিতা-

  •                     লাশ ঘরের চিঠি

খবির হোসেন চৌধুরী

(ইন্দোনেশিয়ার এক মহান চিকিৎসক কোভিড-১৯এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে এসে দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর আপন জনদের দেখে যান। বিদায় বেলা তার স্ত্রী তার ছবি তুলে রাখেন।তার বিদেহী আত্মার শান্তি কমনা করে আমার কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ।)

আমি ডাঃহাইদি আলী, লাশ ঘর থেকে বলছি,
আমি পৃথিবীতে বাঁচতে চেয়েছিলাম তাদের জন্য;
যারা কোভিড-১৯ রোগ যন্ত্রণায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছিলেন।
যারা আমদের দেখে, বাঁচার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।
আমি এই হাসপাতালে বাঁচতে চেয়েছিলাম, তাদের জন্য
যারা আমার হাতের ছোঁয়ায় প্রশান্তির সুবাতাস খু্ঁজে পেয়েছেন,
এক মাত্র আপন জন বন্ধুত্বের পরশ অনুভব করতেন।
আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম এদের জন্য।

কখনো আমি অবচেতন মনে ছিলাম, মৃত্যু সহযাত্রী
অঝর ধারায় কেঁদেছে মন, সকাল -সন্ধা, রাত্রি।
মনের অজান্তে কর্মের হাত, চলে গেছে ওদের বক্ষ পিঞ্জরে।
দেহ মন বাধা পড়েছে, কষ্টের নিঃশ্বাস রত, অবুজ শিশুর বুকে।
ওদের ছল ছল চোখে, আমি প্রকৃতির আলো দেখেছি
উজ্জ্বল সম্ভাবনার ছবি এঁকেছি অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
তবুও আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে, প্রতিদিনই নিঃশব্দে কতো প্রাণের প্রস্থান।

তার পরেও, আশার আলো প্রজ্জ্বলনের আশায়
সরকারি দায়িত্বের সীমানা পেরিয়ে, কর্তব্যের দায়ে
থেকেছি, হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশে।

ভুলে গেছি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, অনাগত সন্তানের কথা,
ভুলে গেছি আমার দুটি কন্যা, চাঁদের আলোর কথা।

ভারী বাতাস,নিরবতা আর চোখের জলে ভিজে গিয়েছি প্রতিদিন।
প্রত্যকটা মানুষের বাঁচার, ঘুরে দাঁড়াবার প্রনান্তকর চেষ্টা।
ওদের সামনে, আমরাই আশ্বাস, বিশ্বাস,নিশ্বাসের শেষ ভরসা।
চোখের সামনে, নিভে গেছে কতো তাজা প্রাণ, সম্ভাবনার ফুল।
দেখেছি কত শিশুর, বুকে ঝাপ দেয়ার করুণ আঁকুতি।
কতো মা তার আপনজনের খোঁজে হতাশ, উৎকন্ঠিত।
হাজারো স্বাক্ষী হয়েছি, শেষ নিঃশ্বাসের অন্তিম ক্ষণের।

একটি উপলব্ধি, বাসা বেঁধেছিলো আমার হৃদয় গহীনে,
হাসপাতালই আমার পরিবার, এটাই আমার শেষ ঠিকানা।
অবশেষে অনুভব করলাম, আমার শরীরে করোনা বাসা বেঁধেছে।
রোগীর বিছানায় আমি, চিকিৎসকের সেবা প্রার্থী।
কষ্টের বিছানায়, যখন আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো,
তখন, কে যেন, বুকের মাঝে বললো,যাও, তোমার স্ত্রী, কন্যাকে দেখে এসো।
কতোদিন হলো প্রিয়তমার সান্নিধ্যে, প্রেমের চাঁদোয়ায় জ্যোৎস্না দেখা হয় নাই।
কতোদিন হলো আমার , প্রিয় কন্যারা ঘুমায় না এই বুকে।
হয়তো আমার অপেক্ষায়, ওরা কষ্টের আলো জ্বেলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা রত।
স্রষ্টার শক্তি, তোমাদের শুভকামনা ধারণ করে চলে গেলাম,
ওদের কছাকাছি নিরাপদ দূরত্বে, ফটকের বাইরে,
ওদের উদগ্রীব হাতকে নিবৃত্ত করলাম,
জানান দিলাম, আমার শরীরে করোনার বাস
দুর থেকে দেখো, দুর থেকে দেখি,এই আমাদের শেষ দেখা দেখি।
ওদের ছু্ঁতে না পারার বেদনায়, আমার নিশ্বাস যেন
পাথর হয়ে আটকে যাচ্চিলো।
আমার প্রিয়তম, শেষ বিদায় বেলার ছবি তুলছিলো
সেই বিষাদের ছবি খানি, রেখে গেলাম তোমাদের জন্যে।

SHARE